বাংলাভাষার আবৃত্তির কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মাজহারুল হক লিপু

কবিতাকে আবৃত্তির কবিতা নামে পৃথক একটি ভাগ করে ফেলা যায় কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। কবিতাতাে কবিতাই। তারপরও কিছ কথা থেকেই যায়। সাহিত্য বিশারদ যারা কখনােই কবিতাকে এরকম ভাগ করবেন না নিশ্চই। তবে যুগে যুগে কিছু কবিতা কেমন করে যেন আবৃত্তির কবিতা হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছে। সাহিত্যের মান অথবা কাব্যিক বিচারে সেসব কবিতায় সবগুলােকেই হয়ত উচ্চমানের কবিতা বলা যায় না। তারপরও আবৃত্তির কবিতাওলােই যে বাংলাভাষার জনপ্রিয়তম কবিতা (সাধারণ মনুষের কাছে) সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইদানিং আবৃত্তির নানান বিভাগের মধ্যে গদ্য আবৃত্তি অথবা শ্রুতি নাটকও বেশ জনপ্রিয়। তারপরও আবৃত্তি বলতেই সহজেই আমরা যা বুঝি বা সবচেয়ে যা প্রচলিত তার নাম কবিতা আবৃত্তি। কবিতা কবির ভাষা। নিজের হৃদয়ের মাঝে খেলা করা কোন বােধকে কেন্দ্র করে কিছু শব্দকে সুবিন্যাসের মাধ্যমে মূর্ত করাই কবিতা। প্রশ্ন থেকে যায়, কবি যখন কবিতা লেখেন তখন কি তিনি পাঠকের কথা ভাবেন? সবক্ষেত্রে নিশ্চই ভাবে না। নিজের ভাবকে শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করাতেই কবির মুক্তি। পাঠককে বােঝানো তার লক্ষ্য নয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় পাঠকের বােকাম্যতা কবির লক্ষ্য না হলেও অধিকাংশ কবিতাই পাঠক নিজের মত করে বুঝে নেন। সেক্ষেত্রে পাঠকের উপলব্ধির সাথে কবির উপলব্ধি মিলতেও পারে আবার নাও পারে।

কবির ধারণাকে যদি পাঠক নিজের মত মর্মোদ্ধার করে নিতে পারেন তবে আবৃত্তির প্রয়ােজন কি? আসলে কবি এবং আবৃত্তিকার দুজন দুমেরুর মানুষ। তাদের মাঝখানে যােগসূত্র স্থাপন করে কবিতা। কবিতা লেখার সময় পাঠকে নিয়ে কবি ভাবতেও পারেন কিংবা নাও পারেন। কিন্তু আবৃত্তিকারকে কিন্তু ভাবতেই হয় শ্রোতার কথা। কেননা একটি কবিতা শ্রোতার কাছে শিল্পসম্মততাবে উপস্থাপন করাই আবৃত্তিকারের প্রধান লক্ষ্য। তাই আবৃত্তি পরিবেশনার পূর্বেই আবৃত্তিকারকে ভাবতেই হয় তিনি কোন কবিতা আবৃত্তি করবেন। যেহেতু আবৃত্তিকারকে নির্বাচন করতে হয় তাই সব কবিতাই আবৃত্তির কবিতা হয়ে ওঠে না। সৰ কবিতাই শ্রোতার সামনে উপস্থাপনের জন্য যথার্থ বলে নাও ভাবতে পারেন একজন আবৃত্তিকার। কিছু কবিতা আছে যা নিজের মত করে একাকী পড়তেই ভালাে লাগে। কিছু গভীর বােধেরও পাঠক নিজের ভাবতে ভালােবাসে। তাই তা শােনার চেয়ে পড়তেই ভালােবাসে সে।

একটি কবিতা শিল্পসম্মতভাবে শ্রোতার সামনে উপস্থাপন করাই আবৃত্তিকারের কাজ। তাই সেই কবিতাকে নিজে উপলব্ধি করতে হয় সর্বাগ্রে। আবৃত্তি হলাে কবিতার রং। কবি যা লেখেন রংতুলি দিয়ে মূর্ত করে তােলেন আবৃত্তিকার।

বাংলা কৰিতা আর আবৃত্তি একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে। আবৃত্তি কবে থেকে শুরু কিভাবে তা বিকাশ লাভ করল তা নিয়ে আলােচনার প্রয়ােজন বােধ করছি না বরং বাংলা কবিতা, তার আবৃত্তি এবং জনপ্রিয়তা নিয়ে কিছু আলােচনা করা যাক।

বাংলা ভাষার কবিতাসমূহকে ১৯৪৭ এর পর এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার কবিতা বলে ভাগ করা হলেও ভাগ্যক্রমে সেই বিভাজন থেকে রক্ষা পেয়েছেন দেশ বিভাগের পূর্বে জন্ম নেয়া কবিরা। সেই তালিকায় সর্বাগ্রে আছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং জীবনানন্দ দাশ। মূলতঃ এই তিনজন কবির কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়েই আবৃত্তি একটি ভিন্ন মাত্রার শিল্প মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বাংলা ভাষার কবিতার ইতিহাসে একটি কবিতা প্রমাণ করতে পেরেছে যে আবৃত্তির মাধ্যমে একটি কবিতা কতখানি জনপ্রিয়তা পেতে পারে।  কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” কবিতার অদ্যাবধি যে জনপ্রিয়তা এবং যুগে যুগে গণজাগরণে তা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার পিছনে আবৃত্তিশিল্পীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতাটিও আবৃত্তিকারদের কাছে দারুণ প্রিয়। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “দেবতার গ্রাস”, “প্রশ্ন”, “হঠাৎ দেখা”, “বাঁশী”, “সােনার তরী” কবিতাগুলাে শুনলে মনে হয় এগুলাে বােধ হয় আবৃত্তির জন্যই লেখা।

একই সাথে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, গাকুল নাগ, আমার ফরিয়াদ, মানুষ কবিতাগুলাে যুগ যুগ ধরে আবৃত্তি অঙ্গনে সমানভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে। জীবনানন্দ দাশের বাংলার মুখ আমি, আবার আসিব ফিরে, আট বছর আগের একদিন, বােধ কবিতাও জনপ্রিয় আবৃত্তির কবিতা।

উপরােক্ত তিনজন নামের সাথে আরেকজন কবির নাম না বললেই নয় তিনি হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। আবৃত্তিকারদের কাছে তার কবিতাও দারুণ প্রিয়। প্রিয়তমেযু, সিগারেটা, মােরগ, উদ্যোগ কবিতাগুলাে আবৃত্তির মধঞ্চে অতি প্রচলিত কবিতা।

স্বাধীনতা উত্তরকার থেকে অদ্যাবধি এপার বাংলায় জসিম উদদীনের কয়েকটি কবিতা আবৃত্তির কবিতা হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়। এসব কবিতার মধ্যে কবর, গীতারা চলিয়া যাবে, নিমন্ত্রণ কবিতাগুলাে উল্লেখযােগ্য।

এপার বাংলার মধ্যে যার কবিতা সবচেয়ে বেশি আবৃত্তি করা হয় তার নাম শামসুর রাহমান। স্বাধীনতা তুমি কবিতাটি আবৃত্তি করার চেষ্টা করেননি এরকম মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই নগণ্য। এছাড়া তােমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, কালােমেয়ের জন্য পঙতিমালা, বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা, মাষ্টরদার হাতঘড়িও জনপ্রিয় আবৃত্তির কবিতা।

বাংলাদেশের আবৃত্তির মঞ্চে আরাে একটি কবিতা আবৃত্তি না হলে আবৃত্তি অনুষ্ঠানই যেন অপূর্ণ থেকে যায়। অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘নূরলদিনের সারাজীবন কবিতাটির লেখক সৈয়দ শামসুল হক। জনপ্রিয় এ কবির পরাণের গহীন ভিতরে এবং আমার পরিচয় কবিতা দু’টিও আবৃত্তিকারদের কাছে খুবই প্রিয়।

আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাগুলাে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সবচেয়ে বেশি আবৃত্তি করা হয়। এক্ষেত্রে নির্মালেন্দু গুণের হুলিয়া, স্বাধীনতা শব্দটি যেভাবে আমাদের হলাে, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বাতাসে লাশের গন্ধ’, আবুল হাসানের উচ্চারণগুলি শােকের কবিতাগুলাে জনপ্রিয়তা পেয়েছে আবৃত্তিপ্রেমীদের কাছে।

দেশের কবিতা অথবা ভাষা আন্দোলনের কবিতা হিসেবে অনেক কবিতাই আলােড়ন সৃষ্টি করেছে আবৃত্তি অঙ্গনে। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কোন এক মাকে, আমি কিংবদন্তির কথা বলছি, আবু হেনা মােস্তফা কামালের ছবি’, আমি কোন আগস্তক নই, আসাদ চোধুরীর বারবারা বিডলারকে, তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, সিকান্দার আবু জাফরের বাংলা ছাড়াে, রবিউল হুসাইনের এক সেকেন্ডে চার ফুট কবিতাগুলােকে আবৃত্তিকারেরা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

সমসাময়িক কালে ওপার বাংলার কয়েকজন কবির কবিতা সমানভাবে আবৃত্তি করা হয় দুই বাংলায়ই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি, যদি, নির্বাসন দাও, জয় গােম্বামীর স্নান, নূন, জগতের আনন্দ যজ্ঞে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তি, শুভদাস গুপ্তের আমিই সেই মেয়ে, সুবােধ সরকারের শাড়ি, জয়দেব বসুর ভারত এক খোঁজ, নেকড়ে কবিতাগুলাে বিশেষভাবে আবৃত্তি উপযােগী জনপ্রিয় কবিতা। ওপার

বাংলার কবিদের মধ্যে পূর্ণেন্দু পত্রীর সেই গল্পটা এবং কথােপকথন বাংলাদেশে ওপার বাংলার চেয়েও বেশী আবৃত্তি করা হয়।

ফরহাদ মজহারের কর্তৃত্ব গ্রহণ কর নারী, ভাস্কর চৌধুরীর আমার বন্ধু নিরঞ্জন, মহাদেব সাহার চিঠি দিও, মােফাজুল করিমের “নেশার আরাে অসংখ্য কবিতা আছে” যা শুধু আবৃত্তির মাধ্যমেই পৌঁছেছে সাধারণের কাছে।

আবৃত্তির কবিতা বলে কোন কবিতাকেই বিশেষায়িত করবেন না সাহিত্যবােদ্ধারা। তারপরও এরকম অসংখ্য কবিতা আছে সাধারণ মানুষ যাকে আবৃত্তির কবিতা হিসেবেই চেনে।

মন্তব্য: