বাংলা সংস্কৃতি ভাবনা: প্রসঙ্গ পহেলা বৈশাখ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মোজাফ্ফর হোসেন

মুঘল বাদশা আকবর-এর শাসনামলে কৃষিকাজ ও কৃষকদের খাজনা প্রদানের সুবিধার্থে ভারতীয় স্যোলার ক্যালিন্ড্যার বা সৈার-পঞ্জিকা ও হিজরি লুনার ক্যালিন্ড্যার বা চান্দ্র-পঞ্জিকার ওপর ভিত্তি করে বাদশা আকবর-এর নির্দেশে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফাতেউল্লাহ শিরাজি বাংলা পঞ্জিকা প্রণয়ন করেন যেটা বঙ্গাব্দ বা বাংলা অধিবর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। পহেলা বৈশাখের উদ্যাপন আকবরের আমল কিংবা আরও আগে থেকেই শুরু হয়। চৈত্রের শেষ দিনে কৃষকরা তাদের সমস্ত লেনদেন ভূস্বামীদের বুঝিয়ে দিতেন এবং বৈশাখের প্রথম দিনে ভূস্বামীরা কৃষকদের মিষ্টি মুখ করাতেন। এই দিনে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে মেলা বসতো। ফলশ্রুতিতে দিনটি বাঙ্গালীদের পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত  হলো। এই দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো হালখাতা বা হিসেবের নতুন খাতা প্রস্তুতকরণ। যা অদ্যবদি এদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত আছে।

কলকাতাতে বৈশাখ মাসকে বিবাহের জন্যে আদর্শ সময় মনে করা হত। মানুষজন নতুন পোশাক পরিধান করে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যেত। চৈত্র মাস জুড়ে মানুষ নানাবিধ কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে উদ্যাপনের জন্যে প্রস্তুত করে তুলত। এ সময় পোশাক ব্যবসায়ীরা বেশ ছাড়ে পোষাক বিক্রি করতো। আর বৈশাখ মাস জুড়ে চলতো বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকা-। পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করা হতো। মেয়েরা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে আর ছেলেরা কুর্তা আর ধুতি পরে সকালে নতুন বর্ষবরণে শোভাযাত্রা বের করতো। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের সংস্কৃতির অতি প্রাচীন অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পহেলা বৈশাখ। 

খ.

বর্তমানে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের আগ্রাসী মনোভাবের কারণে অনেক সাধারণ মুসলমান দ্বিধায় পড়ে যায়- কোনটা আমাদের সংস্কৃতি, আরবের মুসলমানরা যেটা করছে ওইটা, নাকি ভারতীয় হিন্দুরা যেটা করছে সেটা! যদি আরবের সংস্কৃতিকে আমাদের সংস্কৃতি মনে করা হয় তাহলে ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, আচার-ব্যবহার অনেক কিছুতেই পরিবর্তন আনতে হয়, যা ভৌগলিক ও বিবিধ কারণে সম্ভব নয়। আবার যদি ভারতীয় হিন্দুদের সংস্কৃতিকে আমাদের সংস্কৃতি বলে মনে করা হয় তাহলে মুসলমানদের ধর্ম-টর্ম বলে কিছু থাকে না। এখন প্রশ্ন হলো- ধর্মই সংস্কৃতি নাকি সংস্কৃতিই ধর্ম? নাকি দুইটা আলাদা বিষয়? কেউ কেউ বলবেন সংস্কৃতিই হলো ধর্ম আবার কেউ কেউ বলবেন ধর্মই সংস্কৃতি। দুটোকে আলাদা করে চিহ্নিত করার চেষ্টাও করবেন কেউ কেউ। কাজেই এখান থেকে আমাদের বাঙ্গালির সংস্কৃতি যে কোনটা সেটা নির্নয় করা বেশ কষ্টকর। এখন আমাদের সংস্কৃতি কোনটা সেটা নির্ণয় করতে হলে আমাদের পিছনে ফিরে যেতে হবে। আমাদের বাঙ্গালীদের নিজস্ব একটা সংস্কৃতি অবশ্যই আছে এবং সেটা বিশেষ কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংস্কৃতি না। পহেলা বৈশাখ হলো তেমনই একটি সংস্কৃতি। ধর্ম-বর্ণ, ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত বাঙ্গালীর অতি প্রাণের উৎসব এই পহেলা বৈশাখ। তৎকালীন পাক-শাসনামলে পূর্ব বাংলাকে মুসলমানদের ভূখ- বিবেচনা করে এবং পহেলা বৈশাখকে প্রকৃতি-পূজা বা হিন্দুদের আচার হিসেবে প্রচার করে পাক-সরকার কৌশলে বাঙ্গালীদের সংস্কৃতিহীন করার যে হীন মতলব আটে তাতে অনেক বাঙ্গালী মুসলমান বিভ্রান্তে পড়ে যায়। পরবর্তীতে ’৫২-তে সংগ্রাম করে ভাষা অর্জনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে নতুন করে সচেতন হতে শুরু করে। ’৭১-এ একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের পাশাপাশি আমরা পাই আমাদের সংস্কৃতির স্বাধীনতা। বলা যায় দীর্ঘ সময় যুদ্ধ করে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই স্বাধীনতা পাই বলেই আমরা আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি ওয়াকিফহাল হয়ে উঠি। ফলত পহেলা বৈশাখ হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমান সকলের প্রাণের উৎসব। এবং বাঙ্গালীর জাতীয় ও সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান তো বটেই। সমগ্র বৈশাখ মাস হয়ে ওঠে বাঙালীর আপন সংস্কৃতির চর্চা, সাধনা ও প্রেরণার মাস।

পহেলা বৈশাখের সাথে আমাদের অনেক পুরানো সংস্কৃতি জড়িয়ে ছিল, যেমন- যাত্রা, পালা গান, কবি গান, গাজির গান, অলকাপ গান, পুতুল নাচ, বাউল-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি গান, বর্ণনামূলক নাটক, যেমন- লাইলি-মজনু, রাধা-কৃষ্ণ, ইউসুফ-জুলেখার মঞ্চস্থ, ইত্যাদি যা এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। যদিও পুতুল নাচ ও যাত্রা এখনো কোথাও কোথাও দেখানো হয় তবে তা বিকৃত অবস্থায়। ওটা আমাদের সংস্কৃতি না। গ্রাম অঞ্চলে মেলার নামে যে সকল জুয়ার আসর বসানো হয় সেটাও আমাদের সংস্কৃতি নয়। একসময় ঢাকায় ঘুড়ি উড্ডয়ন, মুন্সিগঞ্জে ষাঁড়ের দৌঁড় প্রতিযোগিতা, এবং গ্রামাঞ্চলে ঘোড়-দৌঁড়, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের যুদ্ধ, নৌকা বাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল যা এখন প্রায় আমাদের বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি হিসেবে গণ্য হচ্ছে। তবে এখনো পহেলা বৈশাখে চট্টগ্রামে বলি ও রাজশাহীতে গম্ভীরা বেশ আড়ম্বরের সাথে পালন করা হয়।

পহেলা বৈশাখ কি শুধুই একটি অনুষ্ঠান? অনুষ্ঠানতো আরো আছে; যেমন- ঈদ, জন্মদিন, বিবাহ, ভালোবাসা দিবস, বাবা দিবস, হ্যাপি নিউ ইয়ার আরো শত শত। এই অনুষ্ঠানগুলোর সাথে পহেলা বৈশাখের পার্থক্যটা কোথায়- এই বিষয়গুলো একটু ভেবে দেখা দরকার।

গ্রাম্য সংস্কৃতির বা কৃষকদের এটাই একমাত্র অনুষ্ঠান যেটা ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানের মর্মমূল হচ্ছে কৃষকদের নতুন ফসল ঘরে তোলা ও জমিদারদের কাছে ঋণমুক্ত হওয়ার আনন্দ। অথচ শহরের কয়জনই বা এই বিষয়ে অবগত থাকেন! জমিদারী প্রথা বিলোপের সাথে সাথে নগরে অর্থাৎ কৃষকদের মাঝে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করার আমেজ বেশ থিতিয়ে এসেছে। তবে বাংলা দিনপঞ্জিকার প্রথম দিন হিসেবে দেশের শহুরে সমাজে এর কদর বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে। বিষয়টি আপাত দৃষ্টিতে আমাদের ভেতরে আশার সঞ্চার করে বটে; কিন্তু একটু তলিয়ে এবং খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আজকাল সবখানেই আমাদের সংস্কৃতি চর্চার নামে যা হচ্ছে সেটা  হলো তার বিকৃতিকরণ- ভাষা থেকে শুরু করে পোশাক, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, খাদ্যাভ্যাস সবখানেই। আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি এখন ব্যবসায়ের পণ্যতে পরিণত হয়েছে। আমাদের লোকজ সংস্কৃতিকে বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ বিশেষ কায়দায় প্রদর্শন করে  সর্বোচ্চ মুনাফা আদায় করছে বহুমুখী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো; টেলিভিশন ও প্রিন্টেড মিডিয়া রঙিন রঙিন ছবি পেশ করে কাটতি বাড়াচ্ছে বহুগুণে, ১০০টি এসএমএস ফ্রি দেওয়া হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্যে- এমনই সস্তা আবেগ আমাদের! আমি এসবের কোন কিছুকেই দোষের মনে করছি না। কিন্তু যখন ‘অতিরিক্ত’ ছাপিয়ে ওঠে ‘প্রকৃত’ আয়োজনকে তখন মাথা ব্যথা করে বৈকি। 

গ.

রমনার বটমূলে (১৯৬৫ সাল থেকে) রবীন্দ্রনাথের ‘এসো হে বৈশাখ এসো হে..’ গানের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার বাঙ্গালী পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেই। এখানে প্রকাশ পায় বাংলার স্বাধীন মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাস-এর বহিঃপ্রকাশ। সমস্ত জাতি একই কাতারে সামিল হয়ে আনন্দ উদ্যাপন করে এমন দিন আমাদের জাতীয় জীবনে হরহামেশা আসে না। অন্তত আমাদের মতো দরিদ্র-দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে তো সেটা কল্পনা করাই আকাশ কুসুম চিন্তার সামিল। হাজার সমস্যায় জর্জরিত আমাদের জীবন প্রবাহ, সমাজ ও রাষ্টীয় ব্যবস্থা। এমন অবস্থায় পহেলা বৈশাখ প্রতি বছর সমগ্র বাঙ্গালীর দেহে এক চিলতে প্রাণের সঞ্চার করে। এবং সেটা রমনার বটমূলে বেশ স্পষ্টত হয়। তবে এখানে যা হয় তার সবটা আমাদের সংস্কৃতি না। ২০০১ সালে বোমা হামলা, প্রতি বছরই যত্রতত্র নারীদের টিজিং এর স্বীকার হওয়া। আর ১০০-২০০ টাকা দরে এক প্লেট পান্তা-ইলিশ খাওয়া। চাইনিজ বা থাই না খেলে যে বাঙ্গালীদের আজকাল জাত রক্ষা হয় না, সে বাঙ্গালীদের বছরে এই একটি দিনে আয়েশ করে পান্তা-ইলিশ ভক্ষণ করে বাঙ্গালীত্ব জাহির করার যে প্রয়াস তা আমাদের পূর্বপুরুষদের দরিদ্রতাকে প্রচ-ভাবে অপমান করে এবং হেয় করে আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যত দিন যাচ্ছে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন তত বেশি আড়ম্বরময় হচ্ছে। তার মানে কি এই যে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বাঙ্গালীত্ব আরো প্রগাঢ় ও গূঢ় হচ্ছে?- বোধহয় না। মিথ্যাকে জাহির করার জন্যই তো ঢাক-ঢোলের প্রয়োজন বেশি! আমরা যে আমাদের হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় অর্জিত সংস্কৃতি থেকে ক্রমান্বয়ে ছিটকে যাচ্ছি সেটা ঢেকে রাখার জন্যেই এত বাদ্য পেটানো। নিজের বিবেককে ঠেকানো ও ঠকানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম এটা।

অতি আড়ম্বরের সাথে নেচে-গেয়ে পহেলা বৈশাখ পালন এখনকার প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় ফ্যাশন ও প্যাশন হয়ে উঠেছে। আর পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে কোনও ফ্যাশনই সময়কে জয় করতে পারেনি। তাই আমাদের সংস্কৃতির আচার ও অনুষ্ঠানগুলো যেদিন থেকে ফ্যাশন-এর কারণ হয়ে উঠেছে সেদিন থেকে শুরু হয়েছে আমাদের সংস্কৃতির চরম সর্বনাশ। একটা জাতি যখন তাদের সংস্কৃতি ও লোকাচারকে বাইরে বের করে আনে তখন তাদের শূন্য অন্দরমহলে অন্য কোনও সংস্কৃতি গোপনে দানা বাঁধতে থাকে। আমাদের ভেতরে এমনটি হচ্ছে না তো? একটু বুকের ভেতরটা নেড়ে-ঘেঁটে দেখা খুব জরুরী হয়ে উঠেছে। স্বদেশ ও সংস্কৃতিকে আপন অন্তরে লালন করতে হবে। তাই বলে কি অনুষ্ঠান, আমেজ-আনন্দ করা যাবে না? অবশ্যই যাবে। বাড়িতে নতুন অতিথির আগমনে আমরা আনন্দ-অনুষ্ঠান করি না- ব্যাপারটা হতে হবে ঐরকম, অন্তর থেকে উৎসারিত।

ঘ.

আমরা দরিদ্র জাতি। নানা সমস্যায় জর্জরিত। তারপর আবার আমরা চরমভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। সম্পদের সুষম বণ্টন নেই বললেই চলে। সুতরাং পাশাপাশি দুই বাড়িতে দুই রকম সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের সংস্কৃতি আর হকার্স মার্কেটের সংস্কৃতি কি এক হল! বড় বড় শিল্পপতি, এমপি, মন্ত্রী সমাজের সাথে বস্তি সমাজের সংস্কৃতির কি কোনও মিল আছে! দেশের সর্বত্র এখন সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে বেশি। তার চরম দৃষ্টান্ত আমরা জাতিয় সংসদ ভবনে অধিবেশন চলাকালে লক্ষ্য করছি, লক্ষ্য করছি বিরোধী ও ক্ষমতাশীন দলের নেতা-নেত্রীদের ভাষণে ও বক্তব্যে। একটি জাতির যখন রাজনীতিতে কুষ্ঠ হয় এবং পচন ধরে ভাষায় তখন সেই দেশের সংস্কৃতি ধ্বংস হতে বাধ্য। ভাষায় যে পচন ধরেছে তা আমরা টেলিভিশন ও রেডিও খুললেই টের পাই। এই পচন এখন শিল্প ও সাহিত্যেও দেখা দিয়েছে। যে ভাষার একসময় প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক- এঁদের মতো সুসাহিত্যিকরা সেই ভাষায় এখন প্রতিনিধিত্ব করছেন কিছু দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির সাহিত্যিক। মাঝারি মানের লেখক তখনও ছিল কিন্তু এখনকার মতো তাঁরা দাপিয়ে বেড়াত না। সেই সুযোগ তখন ছিলই না। আর চলচ্চিত্রের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। এখনকার বাংলা সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্যগুলো এত সময় নিয়ে ও গুরুত্ব সহকারে দেখানো হয় যে বোঝাই যায় না পরিচালক ধর্ষণের পক্ষে না বিপক্ষে অবস্থান করছেন! সমস্যার এখানেই শেষ না। আমরা বাঙ্গালীরা দিনে দিনে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও সুবিধাভোগী হয়ে উঠছি। সাদা বাংলায় সবাই ক্রিমিনাল হয়ে উঠছি। ঘুষ ছাড়া আমরা কাজ করি না। এক দিকে ঘুষ নিতে যেমন দ্বিধা বোধ করি না, অন্য দিকে দিতেও তেমন দ্বিধা বোধ করি না। বরং লোক সমাজে দাঁত বের করে বলি- আমার ছেলেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ওখানে ঢুকিয়ে দিলাম। আবার ক্ষেত্রবিশেষ দেশের জনগণও দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যায়- একদল সরকারের, মানে সুবিধাভোগী; আরেক দল বিরোধী দলের, মানে অবহেলিত। টাকা ও ক্ষমতার বলে এখন নির্ধারিত হচ্ছে চূড়ান্ত যোগ্যতা। পরিস্থিতি এমন যে ধনী, মধ্যবিত্ত, গরীব, ভিখারি কেউ আর সৎ থাকতে চায়ছে না। বাড়ছে ক্রিমিনাল বাড়ছে মসজিদ মন্দিরের সংখ্যাও। এই অবস্থায় আমরা আলোচনা করছি আমাদের সংস্কৃতির সম্ভাবনা নিয়ে। দুটোই চরম আইরনি। আমাদের সংস্কৃতি রসাতলে যাচ্ছে ভেবে আমরা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি, চিন্তায় আমাদের খাবার হজম হচ্ছে না। একবারও ভেবে দেখছি না, আমরা ঠিক আছি তো? আমরা রোগকে বাদ দিয়ে রোগীর পিছনে ছুটছি নাতো! এখন প্রশ্ন হলো – আমরা নষ্ট হচ্ছি বলেই কি আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে, নাকি আমাদের সংস্কৃতি নষ্ট হচ্ছে বলেই আমরা নষ্ট হচ্ছি? আমার মনে হয়, দুটোকে আলাদা করে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। 

ঙ.

আমি আমাদের সংস্কৃতি চর্চার সবখানেই হতাশাবাদ ব্যক্ত করে আলোচ্য লেখার ইতি টানবো না। আশার ব্যাপার হলো, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই দেশ ও দেশের সংস্কৃতি নিয়ে ভাবছে। দেশ যত অর্থনৈতিকভাবে সবল হবে আমাদের সংস্কৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসাও তত প্রগাঢ় হবে। সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের হাত থেকে আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করাই একবিংশ শতকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাঙ্গালীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে তখনই যখন তাদের স্বকীয়তা বা নিজস্বতা তুলে ধরতে পারবে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর উদ্যাপন সেই সম্ভাবনার কথায় জানান দেয়। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের মতো বলতেই হচ্ছে, আমাদেরকে নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে আপন করতে শিখতে হবে, অন্যথায় প্রকৃত মুক্তি মিলবে না। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনেই আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটুক এই প্রত্যাশাই রইল আগামীর কাছে। জয়তু পহেলা বৈশাখ! জয়তু

মন্তব্য: