মোহাম্মদ নূরুল হক
সৎ সাহিত্যিক মাত্রই সমাজ চিন্তক; রাষ্ট্রচিন্তকও। উৎকৃষ্ট কবিতা-উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক একইসঙ্গে শিল্প ও রাষ্ট্রচিন্তার মৌল প্রেরণাও। ফলে বড় কবি-কথাশিল্পী হয়ে ওঠেন শ্রেষ্টতম জীবনশিল্পীও। তাই সমাজ-রাজনীতি, ধর্ম-দর্শন ও অর্থনৈতিক বিষয়ও সৎসাহিত্যকর্মের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। বিপরীতে গৌণরা চিন্তার সঙ্কটে ভুগে সৃজনকর্মকে করে তোলেন কল্পনাবিলাস। ফলে কবিতা ভরে ওঠে ভাবালুতাসর্বস্ব প্রগলভতায়, উপন্যাস-ছোটগল্প-নাটক হয়ে ওঠে অন্তঃসারশূন্য ফেনায়িত বুদ্বুদ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের পাতায় পাতায় কবি-কথাশিল্পীরা চিৎপ্রকর্ষের স্বাক্ষর এঁকেছেন; সঙ্গে সুচিন্তারও। শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রচিন্তার স্মারক। বাদ যায়নি সমাজভাবনা-ধর্মচিন্তা ও আর্থিক বিষয়ও। এভাবে চিন্তার প্রাখর্য, বুদ্ধির দীপ্তি ও চিৎপ্রকর্ষের মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম।
সুচিন্তক সাহিত্যিককে প্রথমে সমাজসচেতন হতে হয়। সমাজসচেতনতাভিন্ন জীবনশিল্পী হয়ে ওঠা স্বপ্নবিলাস মাত্র। “সাহিত্যিকের সমাজচেতনা যেন তাকে তার ‘স্বদেশ’ থেকে নির্বাসিত না করে। তিনি সমাজের একজন বলে সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণ করা তাঁর কর্তব্য; সাহিত্যিক বলে সৌন্দর্যের তপস্যা তার ধর্ম। এবং ঐ বস্তু যদি একই আধারে ধৃত হয় তা হলে মানুষের মনে এমন কোনো চৈন প্রাচীর নেই যা ও-দুটিকে পৃথক রাখতে পারে”। (সাহিত্যিকের সমাজচেতনা: আবু সয়ীদ আইয়ুব)। সৌন্দর্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে একটি অচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। সুসাহিত্যিক কখনও আপন সমাজকে অস্বীকার করে ভিন্ন সমাজের দাসত্ব বরণ করতে পারে না। স্ব-সমাজের নিন্দাভাষ্যসমেত অন্যসমাজের স্তুতি করে করুণা ভিক্ষা তার স্বভাববিরুদ্ধ। পরচিন্তক যখন প্রচল ধারণার শ্রেষ্ঠ সমাজের-শিল্পের-রাজনীতির প্রশংসায় আত্মোৎসর্গ করেন, তখন বিশুদ্ধচিন্তক আপন সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ভিন্ন সমাজব্যবস্থার পরম্পরা তুলনা-প্রতিতুলনা প্রয়াস পান। নিজেকে গড়ে তোলেন শ্রেষ্ঠ সমাজচিন্তকের প্রমূর্তিরূপে। এ শ্রেণীর সমাজসচেতন সাহিত্যিকের চোখে মার্কস-সার্ত্র-রুশো-ভলতেয়ার-ফুকো-দেরিদার মতবাদ যেমন মর্যাদা পায়, তেমনি মান্যতা পায় চণ্ডীদাস-অতীশদীপঙ্কর-লালন-গান্ধি-বিদ্যাসাগর-রামমোহন-বিবেকানন্দ-বঙ্কিম-রবীন্দ্র দর্শনও। তার চিন্তারাজ্যে চিন্তা-মনীষা ও মৌলিকত্বের প্রশ্নে পশ্চিম কখনোই একতরফাভাবে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায় না।
দর্শনের জিজ্ঞাসা, ধর্মের বিধিনিষেধ ও নৈতিক বিচ্যুতির শিল্পরূপ একইসঙ্গে হয়ে উঠতে পারে সৌন্দর্য চর্চার বিষয়- সফোক্লিসের ‘কিংইদিপাস’ পাঠান্তে তার প্রমাণ মেলে। ইদিপাস দৈববাণীর শাপদুষ্ট। তাই জন্মের পর বাবা-মার স্নেহবঞ্চিত। বেড়ে ওঠে অন্যের ঘরে। গণকের ভবিষ্যতবাণীকে সত্যে পরিণত করে পরিণত বয়সে। নিজের অজান্তেই হয়ে ওঠে পিতার হত্যাকারী। মাতৃগর্ভকে কলঙ্কিত করে উৎপাদন করে আপন সন্তান। শেষপর্যন্ত সত্যসন্ধ ইদিপাস আবিষ্কার করে নিজেই পিতৃহন্তারক। তখন ইদিপাস আত্মহত্যার চেয়ে অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকাকে শ্রেয় এবং বড় শাস্তি মনে করে। এখানে প্রকারান্তরে সফোক্লিস দেখিয়েছেন, দৈবশক্তির সীমা অতিক্রম করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ মুক্তচিন্তাপিয়াসী হলেও মূলত দৈবইচ্ছার অধীন। সুতরাং তার পথচলা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু লিউ টলস্টয় হোয়াট ইজ আর্ট গ্রন্থে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেনÑ ‘প্রকৃত মুক্ত মানুষের পক্ষে মানবিক বা দেবী কোনও প্রকার অনুশাসনের অনুবর্তী হওয়ার প্রয়োজন নেই। আনুগত্য অধঃপতিতদেরই চরিত্র-লক্ষণ। অবাধ্যতা বীরের নিশানা। শত্র“-প্রবর্তিত নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজন তাই নেই’। এখানে দৈবশক্তিকে চিত্তের চাঞ্চল্য প্রকাশের পথে শত্র“তার চিহ্নরূপে বিবেচনা করা হয়েছে। সফোক্লিস যেখানে দৈবশক্তিকে মহিমা দেওয়ার পক্ষে, টলস্টয় সেখানে মানুষকে দেবতার উপরে ঠাঁই দেওয়ার পক্ষপাতি।
প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মানবতার জয়গান গাওয়ার প্রমাণ মেলে। কোনও দেবদেবি নয়, ‘সভার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ এই মানবমন্ত্রই শিল্পচিন্তা ও মানবচিন্তার মৌল অহঙ্কার। মনসামঙ্গলেও মানুষ চাঁদ সদাগরের অহঙ্কারকে সম্মান দেখানো হয়েছে। দেবীকে নয়।
মানবচিন্তার অঞ্চলে ফ্রয়েড প্রভাবসঞ্চারি চিন্তক। মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে তার ধারণায় সমাজের উৎপাদনপ্রণালীকে উপেক্ষা করেও প্রজননপ্রণালী ক্রিয়াশীল হতে পারে এবং যৌনপ্রণালীর অন্তর্নিহিত স্বভাবই মানুষের দুরবস্থার জন্য দায়ী। তার মতে প্রভাবে ও শক্তিতে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পার্থক্য পরিবর্তন হয় না, মানবসমাজের প্রবৃত্তিরও কোনও পরিবর্তন হয় না। ফ্রয়েডের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর ভাবনার মিল রয়েছে। তিনি ‘ভাষা, কবিতা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘জীবের কাছে প্রকৃতির চাহিদা এই যে, সে বংশানুক্রুমে পৃথিবীতে টিকে থাকবে। এই চাহিদা মেটাবার জন্য ভাষার কোনো প্রয়োজন হয় না। আত্মরক্ষা প্রজনন ও সন্তান পালন- এই তিন কর্মই বিনা ভাষায় সম্পন্ন ও সুসম্পন্ন হতে পারে’। ফ্রয়েড দেখিয়েছেন উৎপাদনপ্রণালী চিন্তাভিন্নও প্রজননপ্রণালী ক্রিয়াশীল থাকতে পারে, বুদ্ধদেব বসু দেখিয়েছেন প্রজননের জন্য ভাষার কোনও প্রয়োজন নেই। ভাষার সাহায্যে ভাবনাবিনিময় না করেও প্রজননধারা প্রবহমান রাখা সম্ভব, এবং তার জন্য উৎপাদনপ্রণালীও অনিবার্য নয়। এই দুই চিন্তক-সাহিত্যিকের বক্তব্য মান্যতা পেলে মানুষ ও পশুর পার্থক্য ঘুচে যায়। কিন্তু আদিম মানুষের ভাষাহীন স্তর সভ্যপৃথিবীর মানুষ বহু আগে অতিক্রম করে এসেছে। ফ্রয়েড ও বুদ্ধদেবের চিন্তার ঐক্য স্পষ্ট। কিন্তু তার সারবত্তা কী?
নিখাদ সমাজচিন্তকের মতো কবিও সচিন্তক। সমাজপরিবর্তনের চিন্তাধারায় তারও অংশগ্রহণ মর্যাদাপূর্ণ। কিন্তু কলাকৈবল্যবাদীরা কেবল শিল্পের জন্য শিল্পের জয়গান গেয়েছেন; বলেছেন শিল্পী সমাজসেবক নন, নন লোকশিক্ষকও। লোকশিক্ষক হয়তো নন; কিন্তু সুচিন্তক সাহিত্যিকের মনোভূমি জুড়ে সমাজমঙ্গলের চিন্তাভিন্ন অন্য চিন্তা তুচ্ছ। কবিদের সম্পর্কে প্রচল ধারণা- কবি কল্পনাপ্রবণ, সমাজবাস্তবতার সঙ্গে তার সম্পর্ক সুগভীর নয়। কিন্তু এ প্রচল ধারণা অযৌক্তিক। লু আরাগঁ’র-‘কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস’ আজকের প্রেক্ষাপটে গ্রাহ্যতা পায় না। গুরুত্ব হারায় সমাজের অসংখ্য মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ইতিহাসকে উপেক্ষা করে কেবল টেকনিকের নিরীক্ষায় কবির ব্যাপৃত হওয়ার প্রস্তাবনাও। প্রকৃত কবিতা সমাজ-রাষ্ট্র-মানুষকে উপেক্ষা করে রচিত নয়; মানবকল্যাণের উদ্দেশ্য যে কবিতায় উপেক্ষিত, সেকবিতা সাময়িক মনোরঞ্জনের উপাচার হয় মাত্র; চিরকালের মন জাগাতে পারে না। মন জোগাতে পারলেই সে কবিতার উদ্দেশ্য শেষ, চিরকালের পাঠ্য হওয়ার কোনও গুঢ়ার্থ সেখানে থাকে না। কবি সামাজিক, তাই সমাজের ভালো-মন্দে তার ভেতরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। প্রাত্যহিক ঘটনাবলীও তার চিন্তার বিষয়। বড় কবির জন্য কবিতা যেমন সৃজনকর্ম, তেমনি মানবকল্যাণের সহায়ক প্রপঞ্চও- ‘কবিতা আমার ভালোবাসার বিষয়। একটি উৎকৃষ্ট কবিতা দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি ক্ষুদ্রতা, ক্রমাগত মনুষ্যত্ব হরণকারী প্রবণতা, সমাজ নিয়ন্ত্রণাকারী মাতাব্বরের ফাঁপা, ফাঁকা বোলচাল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় আনন্দলোকে, জীবনের অন্তহীন গভীরে। (কালোর ধুলায় লেখা: শামসুর রাহমান)। কবিতা কবির সৃষ্টি ও অস্তিত্বের অংশ। সঙ্গে চিন্তার সারবত্তাও। তাই উৎকৃষ্ট কবিতায় মানবসমাজ চিত্রায়িত হয় আন্তরিক সততার সঙ্গে।
পাঠবিমুখ পাঠক-সমালোচক-সাহিত্য সম্পাদক সমকালে কোনও জীবিত সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ণ দেখলে বিস্ময় প্রকাশ করেন। এ ধরণের শ্রমবিমুখ-পাঠমুর্খ সমালোচকের এ রকম ধারণায় সমসাময়িকদের প্রতি ঈর্ষাপরায়নতাই প্রকাশ পায়। এ শ্রেণীর শ্রমবিমুখ পাঠক-সমালোচক-সাহিত্যসম্পাদক সমকালীনদের সৃজনকর্মে কখনও চিন্তার বীজ খুঁজে পায় না- অসূয়াপ্রবণতার কারণে সমকালীনদের রচনাকর্ম কখনও মনোযোগ দিয়ে পাঠ করেন না। ফলে কেবল অতীতের লেখকদের রচনাকর্মকে সবসময় শ্রেষ্ঠরচনাকর্ম মনে করেন। সে সঙ্গে সে ধরণের রচনাকর্মকে সাহিত্যবিচারের মানদণ্ড হিসেবে গণ্য করেন। নতুন রুচি গঠন ও মানদণ্ড নির্মাণের প্রতি এরা বীতশ্রদ্ধ। সঙ্গতকারণে নতুনকে এরা ভয় পায়। ইয়েটস ‘দ্য স্কলার’ জীবনানন্দ দাশ ‘সমারূঢ়’ কবিতায় বিরূপ সমালোচকদের অগ্রাহ্য করেছেন। আবার হুগোও নিন্দাভাষ্যকারী সমালোচকদের কলেছিলেন- কিল দ্য ডগ, হু ইজ এ রিভিউয়ার। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় শ্লেষ প্রকাশ করেই থেমে থাকেননি, ‘রুচি, বিচার ও অন্যান্য কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধেও তাদের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- ‘কবিতার এমন অনেক আলোচক আছেন যে বিশেষ কোনো দেশের ও সময়ের কিছু কাব্য ছাড়া অন্য কোনো কবিতায় তাদের রুচি নেই। এ ধরণের আলোচকদের লেখা পড়ে মনে হয় কবিতার যুগ আঠারো শতকে ছিল- কিংবা তারো আগে- তারপর তেমন কিছু কাব্য হয়নি আর; এবং তখনকার কবিতায় যা ব্যক্ত হয়েছে তার ভিত্তিতে কাব্যের স্থায়ী মান ঠিক করে নিতে পারা যায়’। (রুচি, বিচার ও অন্যান কথা: জীবনানন্দ দাস)। জীবনানন্দ দাশের অভিযোগের সত্যতা তার উত্তরকালেও সংক্রমিত। জীবনানন্দ দাশ পরবর্তীকালেও জীবদ্দশায় যোগ্যের স্বীকৃতি পায় না। কেবল মৃত ও অতীতের সাহিত্যিকদের সম্পর্কে চর্বিতচর্বণে পাতারপর পাতা ভরে ওঠে। এপ্রবণতা আর কতকাল চলবে?
যখন বিজ্ঞানের সত্য মানবসমাজে প্রতিষ্ঠা পায়নি তখন মানুষ রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ডাক্তারের সাহায্য না নিয়ে শরণাপন্ন হত মাদুলি-তাবিজ-কবজের। এ সময় বাঙালি যুক্তিহীন ভাবাবেগে ভেসে গেছে। বাঙালি বিজ্ঞানকে গ্রহণ করেছে অনেক পরে। বিজ্ঞানের সত্যে যুক্তিগ্রাহ্য আস্থা স্থাপনের আগেÑ ‘উনিশ শতক থেকে আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি অনেকের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়Ñ হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ের মধ্যে। বিশ শতকে জাতীয়তাবাদের ধর্ম সম্পর্কে এই আগ্রহ ধর্মীয় জাতীয়বাদের প্রভাবে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে স্বীকার করতে হবে যে ধর্মের আনুষ্ঠানিতার উৎসাহ যতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে, মানবধর্মের প্রতি তেমন নয়। বরং সমন্বয়ধর্মী, মানবতাবাদের বাঙালির আগ্রহ হ্রাস পেরেছে’। (গোলাম মুরশিদ: বাঙালি সাংস্কৃতি ও বাঙালির বৈশিষ্ট্য)। কিন্তু এ দুরবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। অপরাপর জাতির মতো বাঙালির জীবনেও বিজ্ঞানের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্মান্ধ বাঙালিও কালের পরিক্রমায় হয়ে ওঠে বিজ্ঞানমনস্ক। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের বিশ্বাসের জগতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে। যে সত্য মানবজাতি বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করেছে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার সে সত্যকেই করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। মানুষ যত বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠলো, তত অন্ধবিশ্বাসের প্রবণতা কমে গেল। যে মানুষ ঐশী ধর্মকে প্রশ্নবিহীন শিরোধার্য মেনেছে, সে মানুষই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠার পর ঐশীধর্মের প্রতি প্রবল সংশয় প্রকাশ করেন। ঐশী ধর্ম যেখানে মানুষে যুক্তিহীন আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, বিজ্ঞানের সত্য সেখানে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের সম্পর্ক স্বভাবতই সাংঘর্ষিক। ফলে ভাবালুতাসর্বস্ব ভাববাদ বাস্তবতার কঠিন নিষ্পেষণে মান্যতা পায় না মানবচিন্তার ত্রিসীমায়।
বাঙালি সহƒদয়হƒদয়সংবেদী বলে জ্ঞানীকে সম্মান করে- ভালোবাসে শিল্পীকে। জ্ঞানী তার শ্রদ্ধার পাত্র, শিল্পী ভালোবাসার। শিল্পী-ভাবুক বাঙালি কল্পনার প্রকর্ষণায়-প্রাচুর্যে ও মৌলিকত্বে অনন্য হলেও মননে অনেকটা পরজীবী- একথা অস্বীকার করা যায় না। তাই বাংলায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম রচিত হলেও চিন্তায় ও মৌলিক গবেষণায় ঔপনিবেশিক দাসত্বের শিকার। এ প্রবণতা স্বল্পশিক্ষিত বাঙালির চেয়ে উচ্চশিক্ষিত বাঙালির ক্ষেত্রে প্রবল। চিন্তকের চেয়ে সাহিত্যিক এপ্রবণতা থেকে অনেকটা মুক্ত। কবি-কথাসাহিত্যিকরা প্রায় স্বসমাজের চিত্রই আঁকার পক্ষপাতি। পশ্চিমের জীবনচিত্র অঙ্কনের চেয়ে স্বসমাজের চিত্র এঁকেই এই সাহিত্যিক সমাজ। এ অনুকল্পের সপক্ষে মুকুন্দরাম-মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-তারা শঙ্কর-জীবনানন্দ দাশ-আল মাহমুদ-শঙ্খঘোষ-সৈয়দ ওয়ালি উলাহ-কায়েস আহমদ-আক্তারুজ্জামানা ইলিয়াস-শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্ম বিবেচনা করা যায়। বিপরীতে ভলটেয়ার-রুশো-হেগেল-ফ্রয়েড-ডারউইন-মার্কস-লেলিন-রাশেল-হাইডেগার-ফুকো-দেরিদা সমকক্ষ কজন বাঙালি চিন্তকের সাক্ষাৎ মেলে? ব্যতিক্রম লালন-আরজআলী মাতুব্বর। সেখানেও প্রথম যতটা ভাবুক ততটা চিন্তক নন; দ্বিতীয় চিন্তার প্রশ্নে মৌলিকত্বের চেয়ে বিশ্লেষক ও প্রশ্নতাড়িত বেশি। গায়ত্রি চক্রবর্তী স্পিভাক, বিমল কৃষ্ণ মতিলাল, রনজিৎ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেদ্র পাণ্ডে, গৌতম ভদ্র, গোবিন্দ চন্দ্র। বাঙালির অনেক সীমাবদ্ধতা সত্তে¡ও বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, আবুল ফজল, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, ড. আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, যতিন সরকার ও আহমদ ছফার মননশীলতার মৌলিকত্ব অস্বীকার করা যায় না। একথা অস্বীকার করা যায় না- এ সমাজচিন্তকদের চিন্তার ক্ষেত্র যতটা স্বসমাজভিত্তিক ততটা বৈশ্বিক পটভ‚মিকেন্দ্রিক নয়। সঙ্গতকারণে চিন্তার অঞ্চলজুড়ে বাঙালি চিন্তকের প্রভাব প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিজ্ঞানে এক জগদীশ চন্দ্র বসু ছাড়া কোনও নতুন নাম বিশ্ববাসী শোনেনি।
এ অঞ্চলের চিন্তকরা মৌলিক চিন্তার পরিবর্তে পশ্চিমপ্রবর্তিত চিন্তার চর্বিত চর্বণকে জ্ঞান চর্চার অনিবার্য শর্ত করে তুলেছেন। বাঙালি চিন্তক মূখ্যত রাশেল-ফুকো-ডারউইন-মার্কসের চিন্তাধারার ধারাভাষ্যকার মাত্র। চিন্তার অঞ্চলে একেক জন হয়ে উঠেছেন পশ্চিমাদের টিকা-ভাষ্য রচনাকারী। রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিল্পতত্তে¡র প্রতিটি প্রপঞ্চে স্বকীয় চিন্তার অভাব। বাঙালি শিল্প-সাহিত্যসমালোচক-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজচিন্তক ও বিশ্লেষক আলোচনার শুরুতেই পশ্চিমের তত্ত্বালোচনাভিন্ন আলোচনা শুরুই করতে পারে না। এ শ্রেণীর আলোচক ধরেই নেন- ইংরেজ তাত্ত্বিকদের তত্ত্বালোচনা ব্যতীত আলোচনা অপূর্ণ থেকে যায়? কোনও ইংরেজ সমালোচক বাংলাসাহিত্যালোচনায় কখনও বাংলাভাষায় বাঙালির চিন্তাধারার উদ্ধৃতি দেয়? কেন দেয় না? তারা ধরে নেয়- ইংরেজি জানা অহঙ্কারের বিষয়; না জানা মুর্খতা। সুতরাং তাদের কোনও ভাষা শিখতে হয় না। তাদের ভাষা অন্যরা শিখতে হবে। তাই পরচিন্তাক্রান্ত বাঙালিচিন্তককে পশ্চিমের ক্লিশে কোনও মতবাদও ভাবিয়ে তোলে খুব সহজে। সমাজ বিপ্লবে বাঙালি চিন্তকের কোনও ভ‚মিকা পরিলক্ষিত হয় না। বিদ্যাসাগর-রামমোহন রায়দের বিধবাবিবাহ প্রথা প্রবর্তন এবং সতিদাহ প্রথার উচ্ছেদকে বাদ দিলে বাঙালি চিন্তকের কোনও মৌলিক চিন্তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। দীর্ঘকাল পার হয়ে গেলেও ধর্ম-দর্শন-সাহিত্যে গভীরচিন্তাশীল ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেনি। তবে আহমদ ছফার চিন্তারাজ্য সম্পূর্ণ স্বচ্ছ না হলেও মৌলিকত্বে প্রোজ্জ্বল। তার বাঙালি মুসলমানের মন এবং সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নতুন চিন্তাঋদ্ধ। বাঙালি সাহিত্যিক কল্পনাপ্রবণ; অধিকাংশ সমাজচিন্তকও। যুক্তিরহিত ভাবালুতা চর্চায় জীবনপাত করলেও যুক্তি ও মনীষার সম্মিলনে কোনও বিষয়কে বিশ্লেষণ করতে শেখেনি বাঙালি চিন্তক। বস্তুসত্যের চেয়ে, প্রকৃত ঘটনার অভিঘাতের চেয়ে মিথ ও পুরাণকে তার মনে হয়েছে প্রকৃত চিন্তার বিষয়। তাই উপন্যাস-ছোটগল্প লেখার সময় কল্পনার প্রাবল্যে প্রধান চরিত্রকে করে তোলেন অতিমানবিকগুণসম্পন্ন। বাঙালি সাহিত্যিক তার কথাসাহিত্যের নায়কের কোনও ত্র“টি সহ্য করতে পারেন না, ফলে তাকে অধিকাংশ সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবীর ভ‚মিকায় দেখাতে পছন্দ করেন। এসব চরিত্রে কখনও প্রাত্যহিক জীবনের কোনও মানুষের আচরণ ও বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে মোক্ষম মন্তব্যটি করেছেন বিনয় ঘোষ ‘বাংলার বিদ্বৎসমাজ’ প্রবন্ধে। বলেছেন- ‘যুক্তিবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে ক্রমেই বাঙালি বিদ্বৎসমাজের বড় একটা অংশ গুরুবাদ, ভক্তিবাদ ও অবতারবাদের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে যাচ্ছেন। আর একটা অংশ, যারা বিত্তলোভী ও ক্ষমতালোভী, তারা শাসক-শোষকদের অন্ধ স্তাবকতা করছেন, মান্ধাতার আমলের মামুলি বুলি কপচে। ’ বাঙালি পশ্চিমের সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটল এর গুরুশিষ্য নীতিকে ধ্র“ব নীতি মেনে নেয় নিজের অজান্তেই। ফলে এ অঞ্চলেও গুরুশিষ্য রীতির প্রচলন শুরু হয়। তুলনা-প্রতিতুলনায়ও কেউ কেউ স্বঘোষিত সক্রেটিস হতে পছন্দ করেন। আশ্চর্যের বিষয়Ñ সক্রেটিসের সংগ্রাম ছিল সত্য প্রতিষ্ঠার; বাঙালিপরচিন্তকদের সংগ্রাম থাকে আÍপ্রতিষ্ঠার। সক্রেটিস ছিলেন আস্তিক; বাঙালিচিন্তক নিজেকে নাস্তিক ভাবতেই ভালোবাসেন। অথচ নিজেকে তুলনা করেন সক্রেটিসের সঙ্গে- বিষয়টা হাস্যকর নয়? মহান সক্রেটিসের শেষ উচ্চারণ ছিল- I to die. you to live; which is better, only god knows. কিন্তু পরজীবী বাঙালিচিন্তকদের দাবি নিজেরা স্বয়ম্ভু। এও হাস্যকর দাবি। আস্তিক্য-নাস্তিক্য মানুষের ব্যক্তিগত অভিরুচি। সেখানে ভিন্নমতাবলম্বীকে তিরস্কার করা অসঙ্গত।
বাঙালি ধার করা চিন্তায় আক্রান্ত থাকার ফলে প্রায় চিন্তার সংকেট ভোগে। বাঙালির চিন্তার বন্ধ্যাত্বের জন্য দায়ী রাজনীতি। দলীয় রাজনীতিগ্রস্ত মানুষ সাধারণত অলস-কর্মবিমুখ প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠে। বিশেষ রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ মানুষকে নির্মমভাবে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। মানবতার চেয়ে রাজনৈতিক-ধর্মীয় মতাদর্শ তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে।
সাহিত্যিক কল্পনা বাস্তবতা বিবর্জিত হলেও কেবল আনন্দলাভের স্বার্থে মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু সমাজচিন্তকের উদ্ভট কল্পনা ও চিন্তার অনুকরণ-অনুসরণকে কোনওভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যায় না। একই ব্যক্তি যুগপৎ সাহিত্যিক ও সমাজচিন্তক হওয়ার কারণেও চিন্তার সঙ্কট সৃষ্টি পারে। সাহিত্যশ্লিষ্ট চিন্তা কল্পনা নির্ভর- কাল্পনিক জগত নির্মাণ করে সে কল্পরাজ্যে মানবজাতির জন্য স্বর্গরাজ্য নির্মাণ করে আÍতৃপ্তি পাওয়া কল্পনাপ্রবণ সাহিত্যিকের মৌলিকপ্রবৃত্তি। সাহিত্যিক সমাজের রক্তচক্ষুর ভয়ে, স্বনামে মানবচরিত্রের পরিবর্তে পশুপাখিকে উপন্যাস-ছোটগল্পের চরিত্র হিসেবে সৃষ্টি করতে পারেন। সমাজের অসঙ্গতি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য পশুরাজ্যের অনিয়মকে প্রতীক করে, অন্যায়ের পতনের ঘটিয়ে মানবসমাজকে শিক্ষা দেয় সাহিত্যিক। বাংলাসাহিত্যে এধারা প্রসিদ্ধ; রূপকথা-উপকথায় এধরণের ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যাবে।
কিন্তু সমাজচিন্তককে এধরণের কাল্পনিক জগত নির্মাণ করলে চলে না। তাকে হতে হয় বাস্তবপন্থী, যৌক্তিক ও সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে অবিশ্বাস্য ঘটনার বর্ণনা করেন, তখন সেখানে বস্তুসত্য অন্বেষণের বিষয় গৌণ হয়ে পড়ে। সাহিত্যিক কল্পনার প্রভাব সমাজে পড়ে অনেক পরে, কিন্তু সমাজচিন্তকের প্রভাব প্রায় তাৎক্ষণিক। তাই সমাজচিন্তককে ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয় নির্লিপ্তির ভেতর দিয়ে; হয়ে উঠতে হয় যুক্তিবাদী-সত্যনিষ্ঠ ও বাস্তবানুগ। শিল্পরুচি ও সামাজিক রুচি পরস্পর সম্পূরক না হলেও পরিপূরকও নয়। দুটিই স্বতন্ত্র ধারার চিন্তাপ্রসূত মানবিক অধ্যাস। সে অধিষ্ঠানে সমাজচিন্তক যতটা শ্রদ্ধার পাত্র; ততটা সহিত্যিক নন। মানবপ্রবৃত্তির স্বতঃসিদ্ধ অভিপ্রায়- মানুষের কাছে শিল্পী ভালোবাসার পাত্র; সমাজচিন্তক সশ্রদ্ধ। সঙ্গতকারণে মানুষ শিল্পীসঙ্গ কামনা করলেও সমাজচিন্তকের শরণাপন্ন হয় কালে ভদ্রে। সমাজচিন্তক মানবিক-জাগতিক সংকটে মানুষের ত্রাণকর্তা-পরামর্শক, শিল্পী সেখানে সমব্যথী সহƒদয়হƒদয়সংবেদী মাত্র। আপাতত দৃষ্টিতে মানুষের স্বার্থপরতার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও, স্বার্থপরতার সঙ্গে এ ধরণের আচরণের সম্পর্ক গভীর নয়। বাঙালি চিন্তায় দরিদ্র; কল্পনার প্রাচুর্যে অতুলনীয়।
ইংরেজি সাহিত্যের শেক্সপীয়র-সফোক্লিস-হোমার-মিল্টন-এলিয়ট-ইয়েটসের সঙ্গে সমসাময়িক বাঙালি সাহিত্যিকদের তুলনায় চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতি-মুকুন্দরাম-মাইকেল-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ দাশ-নজরুল-সৈয়দ ওয়ালি উল্লাহ-সৈয়দ শামসুল হক-আলমাহমুদ-শামসুর রাহমান-শঙ্খ ঘোষ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়ের সাহিত্যিক কল্পনার তুলনা করলেই প্রতীয়মান হয়- সাহিত্যিককল্পনায় ইংরেজরা উদ্ভট হলেও বাঙালি যৌক্তিক ও বাস্তববাদী। ইউরোপসহ পশ্চিমের সাহিত্যিকরা যখন দেবদেবীর জয়গান গেয়েছেন তখন বাঙালি সাহিত্যিক মানবমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে সাহিত্যিককল্পনায় বাঙালিসাহিত্যিক প্রাগ্রসর।