বৈশাখের রূপরসগন্ধ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মামুন মুস্তাফা

ভৌগলিকভাবেই স্বীকৃত যে, এ উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া যায় সমগ্র পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ। আর বাংলার জল-মাটি-হাওয়া সেখানে ঢেলেছে অকৃত্রিম সুধা। বাংলার নিসর্গ, প্রকৃতির বিচিত্রতা যুগে যুগে বিশ্ববাসীকে করেছে আকৃষ্ট। যার অন্যতম প্রধান কারণ এর ষড়ঋতু। আর এর সূচনা ‘বৈশাখ’ মাস দিয়ে গ্রীষ্মকালে। ‘বৈশাখ’ বাংলা বারো মাসের প্রথম মাস হলেও বলা যায় বাংলা বারো মাসের শেষ মাস ‘চৈত্র’-এর কিছুটা প্রলম্বিত রূপ। এ সময় গরমের তাপদাহে মানুষ শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে পড়ে। প্রকৃতির পশুপাখির উপরও এর প্রভাব দেখা যায়। ‘বৈশাখ’ তাই যেন প্রকৃতির রাজ্যে অগ্নি-বিকিরণের কাল। কিন্তু এই ‘বৈশাখে’র শুরুতে কাল বৈশাখীর ঝড়ও লক্ষ্য করি। নদী-নালার ভাঁটি বাংলায় এ সময় লঞ্চডুবি এবং এর সাথে সাথে প্রাণহানি নিত্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবু ‘বৈশাখ’ প্রকৃতিতে নিয়ে আসে বিচিত্র ফলের সমাহার, আপামর বাঙালি মেতে ওঠে আম-কাঁঠাল-লিচুর মহোৎসবে বাংলা লোকজ সংস্কৃতির আনন্দ ধারায়।

বাঙালির মনিকোঠায় প্রকৃতির বিশেষত বাংলা ষড়ঋতুর এই নিরহঙ্কার বিচিত্র প্রকাশকে উসকে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের চিরকালীন সম্রাট কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জন্মসূত্রেই প্রকৃতির নিরাভরণ আকর্ষণ নিয়ে তাঁর আবির্ভাব। বহু বিচিত্র প্রকৃতির রাজ্যে কবি যে সুরময় ও আনন্দময় এবং বর্ণগন্ধভরা শুভ্রসুন্দর, শ্যামল সবুজ ও হরিদ্রাভ সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ পান, তাঁর সমগ্র সাহিত্যে সেই প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়। তাই নতুনের বার্তা বহন করে নিয়ে আসা গ্রীষ্মের শুরু তথা একটি বছরের শুরুরও মাস বৈশাখকে আহ্বান করে কবি বলেন, “এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।।/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,/অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।” 

আবার বৈশাখের তাপদাহ, কালবৈশাখির রুদ্ররূপকে স্মরণ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৈশাখ কবিতায় বলেন, “দীপ্তচক্ষু হে শীর্ণ সন্ন্যাসী,/পদ্মাসনে বস আসি রক্তনেত্র তুলিয়া ললাটে,/শুষ্কজল নদীতীরে শস্যশূন্য তৃষাদীর্ণ মাঠে উদাসী প্রবাসী-/…মুহূর্তে অম্বরবক্ষে উলঙ্গিনী শ্যামা/বাজায় বৈশাখী-সন্ধ্যা-ঝঞ্ঝার দামামা।”

বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বৈশাখ কবিতাটি প্রকৃতি বন্দনায় রচিত অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবং কবির চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছে। তেমনি ’৪৭ উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি আবুবকর সিদ্দিকের তেরশ পঁয়ষট্টির পয়লা বৈশাখকে নিয়ে লেখা কবিতা একটি প্রাচীন উৎসবের দিনে কবিতাটি ‘বৈশাখ’কে পাঠ করে সামনে দাঁড় করিয়েছে ব্যতিক্রমী চিন্তাচেতনায়। দীর্ঘ কবিতার কিছু নির্বাচিত অংশ এরকম- “পৃথিবী বুড়িয়ে যায়/যাচ্ছেও/একেকটা বোশেখের ধাক্কা খেয়ে খেয়ে/দিন মাস বছরের ঊর্ণাবর্তে/ঘুরপাক খাওয়া বেচারী/কোথায় যে কোন চুলোয় সেঁধুচ্ছে/কে জানে/…গ্রন্থ আর গ্রন্থকীট/পণ্ডিত ও দার্শনিক/ধার্মিকের শিরোমণি সব/মেদিনীর নটলীলা পরিলক্ষ্য ক’রে/একবাক্যে রায় দিয়েছেন ঢের আগে:/…ভাগ্যিস তেমাথাওলা জ্যোতিষীর দল/পৃথিবীর মরণের তারিখটা বলেননি/বা বলতে ভুলেই গেছেন তাই/ছয় ঋতু বারো মাস অন্তে একবার/‘নববর্ষ’ নামে এক পুরাতন উৎসবে/মাতাল বেতাল হয়ে উঠি/এই সব হাল্কাতরো সমাজের নরনারীজন/দেদার জলসা করি গান গাই/কবিতা ছাপাই/ঢলাঢলি নাচানাচি ভাঁড়ার কাবার/সান্ত¦নার মৃদু হাত/বুলোই এ বুড়ো কাক পৃথিবীর শাদা পালকেতে/প্রাচীন ছায়ার বট বেঁচে থাক আহা!/মায়ের স্নেহের মত বেঁচে থাক আহা!”

গোটা কবিতায় কবি আবুবকর সিদ্দিক বর্তমান সময়ে বাঙালির নিজ সংস্কৃতি উদযাপনের অন্তঃসারশূন্যতাকে রূপক আকারে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য আশাবাদী কবি তবু শেষ পর্যন্ত বাঙালির সংস্কৃতি ও শেকড়ের পুনর্জীবন কামনা করেছেন। তবে বাঙালির এই যে নিজ সংস্কৃতি উদযাপনের অন্তঃসারশূন্যতা তা যেন আজ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আবার এও তো সত্য যে, আমাদের পয়লা বৈশাখ আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাকে আকাশ সংস্কৃতির যুগে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুসারে পালন করতে গিয়ে দেশজ কৃষ্টিঐতিহ্যকে আজকাল গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। এরও বড় কারণ নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রতিযোগিতায় শামিল হওয়া। 

এত কিছুর পরেও, বাঙালির বর্ষবরণ শুধু একটি প্রথম বছরের আগমনী বার্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বিধায় বাংলার কবি-সাহিত্যিকগণ প্রকৃতির নানা বর্ণ-গন্ধ, রূপ-রস বন্দনায় মুখর হয়েছেন যুগে যুগে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, “রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।” আবার গ্রামবাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা জীবন ও প্রকৃতির হরেক রূপ আর ঐশ্বর্যকে বাঙালির ঘরের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পল্লীকবি খ্যাত জসীমউদ্দীন। তাঁর কাব্যের চরিত্রগুলোকে প্রকৃতির রূপে নিরীক্ষণ করেছেন বলে তাদের বর্ণনায় মানুষ ও প্রকৃতির ভিন্নমাত্রিক উপমার মালা আমরা অবলোকন করি, “বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের থান,/সোনায় সোনায় মেলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ।”

ত্রিশোত্তর আধুনিক বুদ্ধিবাদী কবিদের শিল্পচৈতন্যে ঋতুর যে অনুপ্রবেশ তার প্রভাব তাঁদের নিজেদের মননমনীষার অন্তর্গাঢ় ভাবকল্পের রূপায়নের ভেতরেই নিহিত। ফলে তাঁদের বর্ণনায় ঋতুর বৈশিষ্ট্যগুলো প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষতার কারণে ম্লান মনে করার কোনো কারণ নেই: 

ক. হেলেনের প্রেমে আকাশে বাতাসে ঝঞ্ঝার করতল।

দ্যুলোকে ভূলোকে দিশাহারা দেবদেবী।

কাল রজনীতে ঝড় হ’য়ে রজনী গন্ধা-বনে।

বৈশাখী মেঘ মেদুর হয়েছে সুদূর গগনকোণে।        (ক্রেসিডা/বিষ্ণু দে)

খ. আসবে, গ্রীষ্ম, আসবে আবার কৃষ্ণচূড়ায়

ঊষ্ণ শোণিতে, উচ্চ চূড়ার উচ্ছ্বাসে লাল

আকাশের সুখী রেখায়, আসবে শাখায়-শাখায়   

সবুজ শিখায়, পথে-পথে-ঝরা আহলাদি-লাল

ক্লান্ত হৃদয়ে আসবে কি আর, আসবে আবার,

আমার হৃদয়ে আবার, গ্রীষ্ম, আসবে কি আর?         (ফাল্গুনের গুঞ্জন/বুদ্ধদেব বসু)   

আধুনিক মানুষের মন প্রধানত বিজ্ঞাননিষ্ঠ। তথাপি বাঙালির আবেগি মন লোকজ সংস্কৃতির ভেতরে ডুব দিয়ে তুলে আনে সমাজতত্ত্ব, লোকবিশ্বাস ও সংস্কার, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় আচার ইত্যাদি বিচিত্র তথ্য ও তত্ত্ব। সেই লোকজ সংস্কৃতির অনন্যগাথায় ঠাঁই পেয়েছে বাংলার বারোমাস্যাব্যাপী ছয়ঋতু। জীবন চর্চা ও যাপনের প্রতি মুহূর্তে এর মৌলিকত্ব অবিকৃত যা অস্বীকারের উপায় নেই। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালি জনজীবনের বিশ্বস্ত ধারাবিবরণ।

বাংলা সাহিত্যে মুক্তকণ্ঠ বিহঙ্গের মতোই অবারিত অনিবার শিল্পী ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যদিকে বৈশাখী ঝড়ের ন্যায় উদ্দাম ছিল তাঁর সৃজনশীল মানস-চৈতন্যের গতিময় ধারা। তাঁর সেই বন্ধনহীন জীবনে হয়তো সে কারণেই বৈশাখী ঝড় এত প্রিয় ছিল। কাজী নজরুলের আমার সুন্দর প্রবন্ধ থেকে উল্লেখ করা যাক:

সহসা এল ঊর্ধ্বগগনে বৈশাখী ঝড়, প্রগাঢ় নীলকৃষ্ণ মেঘমালাকে জড়িয়ে। ঘন ঘন গম্ভীর ডমরু ধ্বনিতে, বহ্নিবর্ণ দামিনী-নাগিনীর ত্বরিত চঞ্চল সঞ্চারণে আমার বাহিরে-অন্তরে যেন অপরূপ আনন্দ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল। সহসা আমার কণ্ঠে গান হয়ে, সুর হয়ে আর্বিভূত হল “এল রে প্রলয়ঙ্কর সুন্দর বৈশাখী ঝড় মেঘমালা জড়ায়ে।”

প্রকতি বা নিসর্গ একটি ব্যাপক অধ্যায়। প্রকৃতিতে ছয় ঋতু একটি উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু এর বহির্প্রকাশ ঘটে প্রকৃতিতে বিরাজমান চন্দ্র-সূর্য, নদীনালা, গাছপালা, মানুষ ও জীবজন্তু সকল কিছুর ভেতরেই। আর তাই আমরা দেখি গ্রীষ্মে তিতাস নদীর বর্ণনায় অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক সুবিখ্যাত উপন্যাসে ধীরসঞ্চারী অথচ সাবলীল উপস্থাপনায় পাঠককে আকৃষ্ট করেছেন:

চৈত্রমাস গিয়াছে। গ্রীষ্মের বৈশাখেই এ নদীতে জল বাড়িতে থাকে আর উজানি স্রোত বহিতে শুরু করে। নদীর তীরে ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত। তার সরু আল অবধি জল লুটাইয়া পড়িয়াছে।

ষড়ঋতু বাংলার প্রকৃতির নানামুখী প্রকাশের উৎসকে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে এক অভিন্ন যোগসূত্র স্থাপন করেছে। বিশেষত এই ভাঁটিবাংলার নরনারীর জীবনাচারণে বারোম্যাস্যা ছয়ঋতুর সুদূর প্রভাব বিস্তৃত। তাই ‘নববর্ষে’র সাথে সাথে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’র সম্পর্কও অস্বীকারের উপায় থাকে না। এর ‘হালখাতা’ যেন পয়লা বৈশাখেরই আগমনী ধ্বনি। এই সব সংস্কৃতির উৎসারণ ঘিরে ‘বৈশাখ’ বাঙালির জীবনসঞ্চারীতে অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে অনুপ্রবেশ করে।

বছর বছরব্যাপী ঋতুতে ঋতুতে প্রকৃতির যে শোভা ও সৌন্দর্য। তার আগমনে চারদিকে সাজ সাজ রব, তিরোধানে সব আয়োজন শেষ। সেই আধ্যাত্মবাদী চেতনার ভেতরে অসীম জীবনদেবতার গাঢ় মন্থন উঁকি দেয়। ‘বৈশাখ’ যেন প্রকৃতির এই দুই সত্তাকে ধারণ করে এগিয়ে গেছে পরবর্তী ঋতুর কাছে।

মন্তব্য: