বৈশাখ ও ঝড়: রবীন্দ্র-নজরুল কাব্যে একটি খসড়া লেখা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

নুরুজ্জামান মানিক

বৈশাখ পুরাতনের বিদায় ও নবীনবরণ মাস। বৈশাখ আসে ঝড় নিয়ে, বিদায় নেয় ধ্বংসের সহযাত্রী হয়ে। বৈশাখ সাহসী, ক্ষ্যাপা, বৈরী, অশান্ত, অসীম, মারমুখো, নির্দয়। কিন্তু তার সৃজনক্ষমতা শিল্পীর সুনিপূণ সৌকর্যকে হার মানায়, তার নতুন করার পালা তার নবায়নী ধারা প্রকৃতির সকল পারক্ষমকে হার মানায়। কবিগুরু বৈশাখকে আহ্বান করেনঃ

‘এসো হে বৈশাখ! এসো এসো, তাপস নিঃশ্বাস বায়ে…’

কিন্তু বৈশাখকে আহ্বান করে কোন কবিতা লেখেননি নজরুল। (অবশ্য বৈশাখী ঝড় এর ব্যবহার তার একাধিক কবিতায় বিদ্যমান) কেন? আমার ব্যক্তিগত অভিমত, নজরুল স্বয়ং ছিলেন বৈশাখের প্রতীক। তিনি নিজেই কালবৈশাখীর মতো আবির্ভূত হন বাংলা কবিতায়। কবি নিজেই তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় ঘোষণা করেছেন: 

‘আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল বৈশাখীর।’

আমাদের কবিমনে আলোড়ন জাগাতে আসে বৈশাখের বার্তা। প্রেমিকের অন্তর সাধনায় বিশ্বাস ও প্রেমের মাত্রাযোগ ঘটায় এ বৈশাখ। চৈত্রের দাবদাতে জীবন যখন মরুপ্রায়, রোদে পুড়ে কাদামাটি ঠনঠনে, তখনি বৈশাখ আনে ঝড়. সাথে পানির ফোয়ারা, বিজলীর ছোড়া পুঞ্জিভূত শিলা থেকে ঘুর্ণির শঠতা। মহাকবি শেলী তার ‘Ode To The West Wind’ কবিতায় ঝড়ের প্রশস্তি গেয়েছেন-

‘Drive my dead thoughts over the universe,

Like wither’d leaves, to quicken a new birth;

And, by the incantation of this verse,

Scatter, as from an unextinguish’d hearth

Ashes and sparks my words among mankind!’

কারণ, শেলীর বিশ্বাস যে, ঝড় শুকনো পাতা ঝরিয়ে দেয়, সেই নবীন জন্মকে তরান্বিত করে। শেলী প্রকৃতির কাছ থেকে এই জ্ঞান লাভ করেছেন- 

‘The trumpet of a prophecy! 

O Wind, If Winter comes, 

Can Spring be far behind?’

কোন ঋতু যেমন স্থায়ী নয়, তেমনি দুঃখময় সময়ও স্থায়ী নয়।  যখন ঝড় আসে, তখন সে সবকিছু ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিয়ে যায় তার দুর্দান্ত গতি ও প্রচ-তা দ্বারা। এজন্য ঝড় ধ্বংসের প্রতীক। কিন্তু সেই ধ্বংসই আবার সৃষ্টি সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে। কবিগুরু তাই ‘ক্লান্ত বরষের সর্বশেষ গান’ এ ঝড়কে আহ্বান করেন এভাবে-

‘ধাও গান, প্রাণ ভরা ঝড়ের মতর ধর্ব বেগে

অশান্ত আকাশে।

উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা

বিপুল নিঃশ্বাসে।’ 

যেহেতু কবিগুরু নতুনের প্রতি আগ্রহী তাই তিনি আমন্ত্রণ জানান কালবৈশাখীকে-

‘আনন্দে আতঙ্কে নিশি নন্দনে উল্লাসে গরজিয়া

মত্ত হাহা রবে

ঝাড় সঞ্জীব বাধ উন্মাদিনী কালবৈশাখীর

নৃত্য হোক তবে।’

কবিগুরুর ‘বর্ষশেষ’ কবিতায় শেলীর জীবনদর্শন সুস্পষ্টভাবে ততটা চি‎হ্নিত নয়, যতটা নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় ফুটে ওঠে। নজরুল বলেন-

‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রণয় নুতন সৃজন বেদন

আসছে নবীন জীবনহারা অসুন্দররে করতে ছেদন

তাই সে এমন কেনো যেনো

প্রলয় বয়েও আসছে হেসে মধুর হেসে

ভেঙ্গে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর।’

তখন বোঝা যায় দ্বান্দ্বিক দর্শনের সাথে তিনি সুপরিচিত। প্রথম স্তবকেই তাকে বলতে দেখি-

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়’

আমাদের দেশে বৈশাখে যেমন ঝড় হয় তেমনি আশ্বিনেও ঝড় হতে দেখা যায়। অবশ্য, আশ্বিনের ঝড়টা বৈশাখের মতো অবশ্যম্ভাবী নয়। এজন্যই ঝড়ের কথা উঠলেই মনে আসে বৈশাখী ঝড়ের কথা। কালবৈশাখী বলতে আমরা দুরন্ত ঝড়কেই বুঝি। কোন গতিশীল ধ্বংসাত্বক বিষয়ের উপমা দিতে তাই কবিরা উল্লেখ করেন কালবৈশাখীর। নজরুল এর ‘ভাষার গান’ কবিতায় দেখি-

‘নাচে ঐ কালবৈশাখী

কাটাবি কাল বসে কি?

দেরে দেখি

ভিম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি।’

আর রবীন্দ্রনাথ তার ‘পৃথিবী’ তে লিখলেন-

‘বৈশাখে দেখেছি বিদ্যুৎ চঞ্চুবিদ্ধ দিগন্তকে

ছিনিয়ে নিতে এল

কালো শ্যেন পাখির মত তোমার ঝড়

সমস্ত আকাশটা ডেকে উঠল যেন

কেশর দোলা সিংহ;

তার লেজের ঝাপটে ডালপালা আলুথালু করে

হতাশ বনষ্পতি ধুলায় পড়ল উপুড় হয়ে।’

এখানে ঝড় ও বৈশাখ একাত্ব হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। শেলীর ‘Ode To The West Wind’ কিন্তু হেমন্তের ঝড় (আশ্বিনের ঝড়ও বলা যায়)। কবিতাটির প্রথম পংক্তি হলো- ‘O Wild West Wind, thou breath of Autumn’s being’ এখানে স্পষ্টভাবে হেমন্ত এর উল্লেখ আছে। সুতরাং শেলীর ঝড়টা বৈশাখের ঝড় নয়, আশ্বিনের ঝড়। নজরুলের ঝড়ের উপর লেখা দুটি কবিতা হলো- ‘ঝড়ঃ পূর্ব তরঙ্গ’ (কল্লোলে প্রকাশ শ্রাবন মাসে ১৩৩১ সালে) ও ‘ঝড়ঃ পশ্চিম তরঙ্গ’ (বিষের বাঁশি কাব্যে ১৬ই শ্রাবন ১৩৩১ সালে তবে প্রথম প্রকাশ কল্লোল ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যায় ১৩৩১ সালের আষাঢ়ে।

শেলীর (Ode To The West Wind)  রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষশেষ’ এবং নজরুলের ‘ঝড়ঃপশ্চিম তরঙ্গ’ এর রচনাকালের একটা সাদৃশ্য রয়েছে। শেলী তার কবিতা লিখেছিলেন ঝড়ের দিনে (তবে সেটা হেমন্ত এর ঝড়)। রবীন্দ্রনাথ এর ‘বর্ষশেষ’ কবিতার নিচে লেখা আছে, ১৩০৫ সালে ৩০ চৈত্র ঝড়ের দিনে রচিত। আর নজরুল ইসলামের ‘ঝড়ঃ পশ্চিম তরঙ্গ’ লেখার শানে নুজুল সম্পর্কে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন- ‘এই বছরেই (১৯২৪) কবি কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা ও গান লেখেন। তার মধ্যে ‘ঝড়ঃ পশ্চিম তরঙ্গ’ কবিতাটি অন্যতম। … দীর্ঘ আট পৃষ্ঠা কবিতা ব্যাসিলরি ডিসেন্ট্রি ও প্রবল জ্বরের মধ্যে তিন/চার ঘন্টা ধরে একাগ্র মনে লিখে আমাদের শুনিয়ে তবে তিনি বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলেন।’ (হুগলীতে কাজী নজরুল)

বস্তুত, শেলীর (Ode To The West Wind) এর অনুসরণে বা অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ঝড় ও বৈশাখ এর উপর একাধিক কবিতা লিখেছেন। এজরা পাউন্ড এর (Selected Poems) এর ভূমিকায় এলিয়ট বলেছেন ‘যথার্থ মৌলিকতা কবিতার উৎকর্ষসাধন’। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাগুলোর মৌলিকত্ব ঐ উৎকর্ষ সাধন প্রচেষ্টার উপর নির্ভরশীল।

মন্তব্য: