শহীদ কাদরীর কবিতার মত জেগে থাকে নান্দনিক নিউইয়র্ক

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

কানাডায় আসার প্রায় প্রতি বছরই নিউইয়র্ক যাই, কাজে বা বইমেলায় কিংবা সেমিনারে। সময়সীমা সীমিত থাকার কারণে শহীদ কাদরীর সাথে দেখা হয় করা হয় না। বাংলাদেশে সত্তর দশকের শেষ দিকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসায় আমরা আড্ডা দিতে যেতাম। ২০০৫-এ ফোবানা সম্মেলনে এসে কবি-বন্ধু শামস আল মমীনের সাথে ত্রিশ বছর পর আবার শহীদ ভাইয়ের সাথে আড্ডা। অবশ্য মাঝে মাঝে পত্র যোগাযোগ হতো। 

গতবছর আগষ্টে নিউইয়র্কে গেলাম শুধু মাত্র শহীদ ভাইয়ের লোভনীয় আড্ডার আকর্ষণে। সাথে শামস আল মমীন। আর সেখানে গিয়ে পেলাম- দৈনিক সংবাদের নিনি আপাকে, নিনি ওয়াহিদ। তাঁর সাথে একমাত্র মেয়ে শেমন্তী। বিদেশে বেড়ে উঠলেও শাড়ি পরা শেমন্তী স্বদেশের সংস্কৃতিতে নিজেকে পূর্ণ করে তুলছে। নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তিতে পটু। মাঝে মাঝে শেমন্তীর আবৃত্তি আর ইশরাত জাহান নীরা ভাবীর পরিবেশিত গরম গরম চা মাত্রা বাড়িয়ে দিলো আমাদের আড্ডার। নিনি আপার বানানো চালের গুড়োঁয় পেঁয়াজ-ধনিয়াপাতা-মরিচ-মশলা মেশানো পাতলা রুটি আর সব্জীর চপের স্বাদে জমজমাট আড্ডা চললো প্রায় মধ্যরাত অব্দি। 

এখন শহীদ ভাইয়ের সাথে প্রায়ই টেলিফোনে দীর্ঘ আড্ডা হয়। মূলত কবিতাকে ঘিরেই আড্ডায় আড্ডায় আমার ঘুরে বেড়াই সারা পৃথিবী। পৃথিবীর পরিবেশ, বিশ্বসাহিত্য, দেশ-বিদেশের রাজনীতি, ধর্ম-অধর্মের দ্বন্দ্ব, সেক্স- প্রেম, পরচর্চ্চায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে আমাদের আড্ডা। আমাদের আড্ডায় ঘুরে ফিরে আসেন শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার এবং আরো অনেকেই। তিনি স্মৃতিচারণ করেন তাঁর সময়ের আর আমি করি আমার ফেলে আসা ঢাকার দিনগুলোর। তারপর দু’জনে মেলাতে চেষ্টা করি কিছু মিলে, কিছু মিলেনা। শহীদ ভাই বললেন, তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ, কিন্তু মানসিক ভাবে খুবই সুস্থ-সবল। তাঁর বাসার কাছেই থাকেন অসুস্থ হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর খোঁজ খবর নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। ইতোমধ্যে হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে নিয়ে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ শীর্ষক লেখাও লিখেছেন। তাতে তুলে ধরেছেন শহীদ কাদরীর স্বতন্ত্রতা, পূর্ণতা এবং শূন্যতা।

বাংলা কবিতার জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তি শহীদ কাদরী এখন তাঁর জামাইস্থ বাসায় প্রতি মাসে নির্বাচিত কবিদের ‘কবিতা পাঠ ও আবৃত্তি’র আসর করছেন গত আগষ্ট থেকে। কবিতাকে পাঠকের কাছে ইতিবাচক ভাবে উপস্থাপন, সেই সাথে খ্যাতিমানদের ‘অজনপ্রিয় ভালো কবিতাগুলো’ তুলে ধরা এই আসরের উদ্দেশ্য। কবি শহীদ কাদরী আয়োজিত এই কাব্যসন্ধ্যায় আরো থাকছে- কবিদের সাথে আড্ডা, কবিতা কেন পড়ি, কবিতা কেন লিখি।

তিনি মনে করেন- প্রকৃত কবিতার মাঝেই বেঁচে থাকেন একজন শুদ্ধতম কবি। কবিরা সব সময়ই দাঁড়ান সত্যের পক্ষে। তারা মাটিকে ভালোবাসেন বলেই বার বার ফিরে যান অবনত ভালোবাসার কাছে। তাদের কবিতাই হয়ে ওঠে আপামর মানুষের শক্তির উৎস।

এলোমেলো আড্ডা দিতে দিতে শহীদ ভাই বললেন, তোমাদের কানাডায় মূলধারার বেশ ভালো লেখক কবি আছেন। ইকবাল হাসান, লুৎফর রহমান রিটন, মাসুদ খান, সিদ্ধার্থ হক, তুমি। তোমরা ভালো লিখছো। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন কেউ নেই। আমাদের কবিতার অনুষ্ঠানটা কয়দিন চালাতে পারবো, বুঝতে পারছি না!

শহীদ কাদরীর ইচ্ছে- বাংলা কবিতার একটি প্রতিনিধিত্বশীল সঙ্কলণ করা। অনেক দিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পড়ছেন অতি তরুণতম কবিদের কবিতা। মাঝে মাঝে কারো কারো কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন। তবে বেশির ভাগই হতাশাব্যঞ্জক। নতুনত্ব বা উত্তরাধুনিকতার নামে অনেকই গার্বেজ লিখছে। প্রবাসের কবিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গদ্য চর্চার অবস্থা আরো ভয়াবহ।

নিউইয়র্কের দুই কবি তাঁকে নিয়ে দু’টি বই লিখছেন। হাসানআল আবদুল্লাহ ‘শহীদ কাদরী : সময়ের সম্পন্ন স্বর’ এবং সৈয়দ আদনান ‘শহীদ কাদরী বাড়ি নেই’। বই দু’টি দেখে শহীদ কাদরী ভী-ষ-ণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে তাঁর উপর রচিত বই দু’টি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। কারণ, লেখকদ্বয় নিজের মতো করে উল্টাপাল্টা লিখেছেন। শহীদ কাদরী যা বলেন নি, তাঁরা তা-ও শহীদ কাদরীর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। মানে তাঁর বক্তব্য বিকৃতি করেছে বা তাঁর ভাষা লেখকদ্বয় না বুঝেই লিখে দিয়েছেন। ফলে তাঁদের সাথে শহীদ কাদরীর ব্যক্তিগত সম্পর্কও নষ্ট হয়েছে। তাই তাঁকে নিয়ে কেউ কিছু লিখতে চাইলে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য তিনি মোটেও আগ্রহ প্রকাশ করেন না। বরং বিরক্তবোধ করেন।

আমাদের আড্ডায় ঘুরে ফিরে আসে ঢাকা। ঢাকার পুরানা পল্টন। যে পল্টনে থাকতেন বুদ্ধদেব বসু। সেই পল্টনেই থাকতেন শহীদ কাদরীও। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতি আর শহীদ কাদরীর স্মৃতি ভিন্ন। রাতদিন টানা ম্যারাথন আড্ডা চলতো শহীদ কাদরীর পল্টনের বাসায়। সত্তর দশকের সেই আড্ডার সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম আমিও।

পুরানা পল্টন যেনো পুরনো হয়ে গেছে। সেই স্মৃতির শহরে হয়ত আর কোনো দিনই ফেরা হবে না শহীদ কাদরীর। তাই নিউইয়র্কেই নতুন করে ডেরা পেতেছেন। মনে হলো- নিউইয়র্কের মতোই শহীদ কাদরী জ্বলজ্বল করছেন। আবার নিউইয়র্কের মতোই তিনি নিঃসঙ্গ। তাই টরন্টোতে ফিরে আসার পর লিখলাম- ‘শহীদ কাদরীর কবিতার মত জেগে থাকে নান্দনিক নিউইয়র্ক/ জেগে থাকা নিদ্রাহীন নিউইয়র্ক নাকি কখনোই ঘুমায় না!/ না ঘুমিয়েই তৈরি করে স্বপ্নপুরী রহস্যরচনা/ আর তার পায়ের নিচে ইদুঁরের মত ছুটাছুটি করে পাতাল ট্রেন/ ছোটদের খেলনা কাগজের উড়োজাহাজ ছুটতে দেখলেই হঠাৎ আতকে উঠে গিন্সবার্গের নিউইয়র্ক, নিউইয়র্কের বিল বোর্ড, বিল্ডিং, বৃষ্টি…’

মন্তব্য: