সাহিত্যের ছোটকাগজ কতদূর সুসম্পাদিত।। মোহাম্মদ নূরুল হক

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মোহাম্মদ নূরুল হক

সম্পাদকীয়তে রাজা-উজির মারার বুলি কপচাতে-কপচাতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাসুন্দি লিখে রীতিমতো অভিসন্দন্ধর্ভও প্রণয়ন করেন। আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে দৈনিকের শ্রাদ্ধ করতেও ছাড়েন না এসব কাগজের সম্পাদকেরা। অথচ বিশ হাজার টাকার কাগজ করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন বাবদতই সংগ্রহ করেন, লাখ টাকার ওপরে। এ বিজ্ঞাপনগুলোও বহুজাতিক কোম্পানির করুণাভিক্ষা ছাড়া মেলে না। তাহলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ কী?

মানবসভ্যতার সামগ্রিক অগ্রগতির নিয়ামক মানুষের চিন্তাশক্তি। এ শক্তির কল্যাণেই মানুষ অরাজক পরিস্থিতি ও চরাচরের সমস্ত অসুর শক্তিকে পরাজিত করে, জ্ঞানে-বুদ্ধিতে, প্রজ্ঞায়-মনীষায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে দৈবশক্তির ওপরও। যুক্তিহীন পেশীশক্তির লড়াইয়ে যুগে-যুগে নগদ বিজয়ীর মুকুট পরেছে ক্ষমতাবানেরাই। যুক্তি সেখানে স্পর্ধার অভিযোগে পরাভূত হতে বাধ্য হয়েছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানবজীবনের নানা কুসংস্কারকে দূর করার ব্রত নিলেও বিজ্ঞানের সুবিধাভোগীরাও নিজেদের স্বার্থে মুক্তচিন্তার ধারকদের পদানত করার হীনচেষ্টা করেছে। সে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সবাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, পেরেছিলেন দু-ই একজন। তারা সে সব অবিচার ও কুসংস্কারকে ভেঙেচুরে নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। জিয়োদার্নো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি, সক্রেটিস, যিশু খ্রিস্ট থেকে শুরু করে সত্যসন্ধানী প্রত্যেক মহৎ প্রাণের লক্ষ্যই ছিল পরম সত্য প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিরন্তর নিয়োজিত রাখা। আধুনিক সভ্যতার অন্যতম অবদান ছাপাখানা। সে ছাপাখানাও প্রথম দিকে সমাজপতি, পুরোহিত কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের আজ্ঞাবহ যন্ত্র ছিল কেবল। সময়ের বিবর্তনে সে ছাপাখানার কল্যাণে সংবাদপত্র ও সাহিত্য সাময়িকীর উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করে। কিন্তু সেখানে দেখা গেল আরেক সমস্যা। সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলো কেবল প্রথা ও শক্তির পূজারীতে পরিণত হতে লাগলো। তখন সৃষ্টিশীল মানুষের সামনে যে বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিল, তা হলো- ব্যক্তির কল্পনা ও চিন্তার সারাংশকে দার্ঢ্যরে সঙ্গে প্রকাশ করা কী করে সম্ভব? কেউ কেউ তখন উপলব্ধি করলেন যেকোনো ধরাণের প্রতিবন্ধকতামুক্ত মতপ্রকাশের মাধ্যম আবিষ্কারের। হয়তো ওই চিন্তা থেকেই ছোট কাগজের সূচনা।

বড় কাগজ যা ধারণ করতে অক্ষম, ছোট কাগজ তারই প্রযত্ন। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক কারণে বড় কাগজ সব সময় মুক্তচিন্তার পরিচর্যায় আন্তরিকতা ও সততা দেখাতে পারে না। সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্নে বড় কাগজ যে বিষয়কে আপত্তিকর বিবেচনা করে, ছোট কাগজ সে বিষয় প্রকাশে স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো -কোনো রচনা দৈর্ঘ্যরে কারণে বড় কাগজের সৌন্দর্য হানি করে, ছোট কাগজের বাড়ায় শিল্পমান। ছোট কাগজ-বড় কাগজের সম্পর্ক বিরোধের নয়, ধারণক্ষমতার। বড় কাগজের মুখ্য উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। তাই যে বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে ভালো কাটতির সম্ভাবনা, বড় কাগজ সে দিকেই ঝোঁকে। গণরুচির প্রতি বড় কাগজের সমর্থন ও প্ররোচনা তাই প্রতিযোগিতামূলক। সমকালীন ঘটনাপুঞ্জকে পুঁজি করে জনমনে প্রভাব বিস্তার করার মতো উত্তাপ ধারণ করার সামর্র্থ্য বড় কাগজের রয়েছে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বড় কাগজ সাহিত্যচর্চারও উত্তম মাধ্যম। তবে বড় কাগজলগ্ন সাহিত্য পাতাটি যদি সুসম্পাদিত হয়। প্রচারসংখ্যা বেশি হওয়ায় বড় কাগজ মৌলিক চিন্তাধারার সংক্রমণে দ্রুত কার্যকর। ছোট কাগজ ও বড় কাগজ-বিতর্কে ছোট কাগজকর্মীরা ছোট কাগজকে সাহিত্যের সূতিকাগার বলে দাবি করেন সব সময়। দাবিটা অযৌক্তিক নয়; অবাস্তব। অবাস্তব, কারণ, ছোট কাগজ নতুন কোনো লেখক প্রতিষ্ঠা না করে, মৌলিক চিন্তার প্রবর্তন ও পরিচর্যা না করে। সম্পাদনার চেয়ে সংকলনের দিকেই বেশি মনোযোগ অনেক ছোট কাগজকর্মীর।

প্রায় দেখা যায়, ছোট কাগজগুলো বাজারি সাহিত্যসংকলনের প্রতিযোগী হয়ে উঠতে চায়। অথচ প্রকৃত ছোট কাগজের কিছু দায় পালন করা উচিত। ছোট কাগজের মৌলিক দায় মোটামুটি এ রকম: ১. প্রথাগত রীতির বিপরীতে মৌলিক, যৌক্তিক ও নতুন চেতনার উদ্বোধন করা। ২. শিল্পমান অক্ষুণ্ন রেখে সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণের নিরীক্ষাকে প্রণোদিত করা। ৩. সত্য, সুন্দর ও শিল্পের প্রশ্নে আপসহীন থাকা। ৪. চাতুর্য ও ভাবালুতার বিপরীতে প্রজ্ঞা ও মনীষার পথে পরিভ্রমণ করা। ৫. হঠাৎ চিন্তার ঝলকানি নয়; ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ চিন্তা ও মননের পরিচর্যা। ৬. যেকোনো রকমের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি করা। ৭. গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিপরীতে ঔদার্যের স্বাক্ষর থাকা। ৮. অপরিচিতকে পরিচিত এবং নতুনের আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেওয়া। ৯. লেখকের চেয়ে লেখার পরিচর্যা করা। অনেক সময় ছোট কাগজ-সম্পাদক বড় কাগজের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বৃত্তাবদ্ধ অন্যান্য ছোট কাগজের সম্পাদককে প্ররোচিত করেন। পরস্পরের মধ্যে চলে এ নিয়ে গোপন আঁতাত। এরা প্রশংসা ভুলে স্তুতি, সমালোচনার পরিবর্তে নিন্দাবাক্যের প্লাবনে ভেসে যায়। ছোট কাগজ কী? কী তার কর্মপরিধি?

প্রশ্ন যত সহজ, উত্তর ততধিক কঠিন। কঠিন এ জন্য, ছোট কাগজ বলে প্রচলিত কাগজগুলোয় যে ধরনের কবিতা-গল্প-গদ্য-উপন্যাস পাওয়া যায়, সে ধরনের রচনার সাক্ষাৎ দৈনিকলগ্ন সাহিত্য পাতায়ও মেলে। স্বল্পদৈর্ঘ্য রচনাগুলো সাহিত্য পত্রিকাগুলোয়ও পাওয়া যায়। তাহলে ছোট কাগজের কাজ কী? যদি নতুন কোনো লেখককে উপস্থাপন করা না যায়, তাহলে ছোট কাগজের মূল্য কী? সুসম্পাদিত ছোট কাগজ কেবল লেখা পত্রস্থ করেই দায় সারে না, সঙ্গে পরিচর্যাও করে। যে কাগজ লেখা পাওয়ামাত্রই পত্রস্থ করে, সেটি ছোট কাগজ নয়; সংকলন। কর্ণধারও ছোট কাগজ সম্পাদক নন, সংকলক। সংকলক চলেন প্রথাগত পথে, ছোট কাগজ স্বসৃষ্ট পথে। এ দুয়ের পার্থক্য সুস্পষ্ট।

তীক্ষ্ম বোধসম্পন্ন না হলে ছোট কাগজ সম্পাদকের চলে না। কেবল প্রতিষ্ঠিত লেখকের তল্পিবাহক হলে ছোট কাগজের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। ছোট কাগজ সাহিত্যের সূতিকাগার, সাহিত্যিকের নয়। এখানে দ্যুতিময় রচনাটি প্রকাশিত হয়, খ্যাতিমান লেখক নন। যে কাগজে দ্যুতিময় লেখকের পূজা চলে, সে কাগজ ছোট কাগজ নয়। সে কাগজ ব্যক্তিবিশেষের পূজারি, ইশতেহার মাত্র। লেখক তৈরির পাশাপাশি সৎ-সমালোচনার ধারা সৃষ্টিতে সহযোগিতা করাও ছোট কাগজের কাজ। যুগের দায় মেটানোর বিপরীতে নতুন যুগ সৃষ্টিই এর উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। প্রমথ চৌধুরী চারদিকের অস্বাস্থ্যকর সাহিত্যিক পরিবেশ থেকে ব্যথিত হয়েছিলেন বলেই ১৯১৪ সালে প্রকাশ করেন ‘সবুজপত্র’। এ কাগজটি প্রকৃতপক্ষে সবুজেরই অভিযাত্রার অধিক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এ কাগজেই রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকর্ম প্রকাশিত। প্রথমজনের আশ্রয় নবায়ন-নিরীক্ষার; দ্বিতীয়জনের পরিচর্যার। সবুজপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল মননশীল গদ্য। প্রথাভাঙার জোয়ার দেখা দিয়েছিল। প্রমথ চৌধুরী সে জোয়ারের উদ্বোধক, রবীন্দ্রনাথ তার সহযাত্রী। ফলে প্রমথ চৌধুরীর গদ্যভাষায় রবীন্দ্রনাথ অনুপ্রাণিত হয়ে নিজেকে নবায়ন শুরু করেছিলেন, সময়ের স্রোত শনাক্ত করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। সবুজপত্র একটি যুগের স্রষ্টা। কাগজটি থেকেই উঠে এসেছেন, একজন সম্পন্ন প্রমথ চৌধুরী, আরেক নতুন ও পরিবর্তিত রবীন্দ্রনাথ। ‘সবুজপত্র’ বাংলা ভাষার চেহারা পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠতম কুশীলবও। সে হিসেবে সবুজপত্রও ছোট কাগজ; ‘বঙ্গদর্শন’ আর ‘সাধনা’ও।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ (১৯২৬) ছোট কাগজ নয়? এ কাগজেই নজরুলের কালজয়ী সাহিত্য প্রকাশিত হয়। ‘শিখা’ (১৯২৭) পত্রিকায় মুক্তবুদ্ধি চর্চার আশ্রয় যতটা, ততটা সাহিত্যের প্রযত্ন হয়ে ওঠেনি। বুদ্ধদেব বসু ও অজিত দত্ত সম্পাদিত ‘প্রগতি’ (১৯২৭) শিল্প-সাহিত্যে প্রথম বৃত্তাবদ্ধ চেতনার মূলে আঘাত করে সাফল্য অর্জন করে। যে সংগ্রাম শিখা শুরু করে, সে সংগ্রাম সাফল্য অর্জন করে প্রগতি প্রকাশের মাধ্যমে। শিখা মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানচর্চার কাগজ; প্রগতি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির আশ্রয়। সঙ্গত কারণে শিখার চেয়ে প্রগতি দ্রুত প্রভাব বিস্তারে সমর্থ হয়। অজয় ভট্টাচার্য ও অজিতকুমার গুহ সম্পাদিত ‘পূর্বাশা’? এ কাগজটি কি ভালো লেখার পরিচর্যা করেনি? কাগজটি ক্ষীণজীবী হওয়ায় কোনো সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ‘পরিচয়’ও ছোট কাগজ। কিন্তু যতটা বুদ্ধির আকর, ততটা প্রাণচাঞ্চল্য না থাকায় সংবেদ সৃষ্টি হয়নি। বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকাই প্রথম সার্থক ছোট কাগজ। যে কাগজটির জন্মই একটি দ্রোহ ও জিজ্ঞাসা থেকে। সে সঙ্গে ‘পরিচয়’ পত্রিকার নামও স্মর্তব্য। ‘পরিচয়’ অনেকটা গুণবিচারী ছিল। বিশুদ্ধ সাহিত্যের সেবা করাই সে পত্রিকার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু নতুনকে আহ্বান করা, পরিচর্যা করার প্রথম দায়ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু। তাই ‘কবিতা’ পত্রিকাই প্রথম এবং সংজ্ঞাপূর্ণ ছোট কাগজ।

বুদ্ধদেব বসুর পরিচর্যায়ই মূলত বাঙালির আধুনিকতারই বিকাশ সাধিত হয়েছিল। বিশেষত কবিতাকে দীক্ষিত পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অনুসরণযোগ্য; অনুকরণীয়ও। বুদ্ধদেবে বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একঝাঁক কবির অভিষেক, উন্মেষ ও বিকাশের একক কৃতিত্বের দাবিদার ওই কাগজটি। যার তুল্য ছোট কাগজ পরবর্তীকালে আর প্রকাশিত হয়নি। ব্যতিক্রম পশ্চিম বঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’। ফজল শাহাবুদ্দিন সম্পাদিত ‘কবিকণ্ঠ’ প্রতিষ্ঠিতদের লেখায় পরিপূর্ণ। এদিক থেকে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ ব্যতিক্রম। এ কাগজে নতুনদের অবাধ বিচরণ লক্ষণীয়। ‘সমকাল’ বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার অভাব কিছুটা পূরণ করলেও ‘স্বাক্ষর’, ‘স্যাড জেনারেশন’, ‘কণ্ঠস্বর’ চমক দেখানোয়তেই ব্যস্ত ছিল। তবে ‘কণ্ঠস্বর’ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। কাগজটির সঙ্গে জড়িতরাই পরবর্তীকালে স্বমহিমায় ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন। কামাল বিন মাহতাব, একজন সাহিত্য অন্তঃপ্রাণ। তার সম্পাদিত গল্পের ছোট কাগজ ‘ছোটগল্প’। ছোটগল্প চর্চার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল একটি ছোট কাগজ। সাহিত্যের পরিচর্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে আনওয়ার আহমদ সম্পাদিত ‘কিছুধ্বনি’, ‘রূপম’, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত ‘একবিংশ’, হেনরী স্বপন সম্পাদিত ‘জীবনানন্দ’, আমিনুর রহমান সুলতান সম্পাদিত ‘অমিত্রাক্ষর’, এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত ‘লিরিক’, আক্তার হোসাইন সম্পাদিত ‘পঙ্ক্তিমালা’। কিছু কিছু ছোট কাগজ যতটা সাহিত্যপ্রেমী, তারও বেশি বাণিজ্যিক। স্তাবকগোষ্ঠী লালনের প্রবণতাও লক্ষণীয়। এসব কাগজের গোষ্ঠীবদ্ধতা ভয়াবহ। বৃত্তের ক্ষুদ্রকে বৃহৎ, আর বৃত্তের বাইরের বৃহৎকে ক্ষুদ্রজ্ঞানে তাচ্ছিল্য করার স্বভাব এসব ছোট কাগজের মজ্জাগত। ফলে এ কাগজগুলো গোষ্ঠীপ্রীতি ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে প্রায়ই।

এ কারণে অক্ষম লেখকদের মধ্যে পরশ্রীকাতরতার জন্ম হয়। অন্যের সাফল্য দেখে তারা আঁতকে ওঠে। নিজেদের লেখার প্রভাব পাঠক-সমাজে পড়ে না বলে, তারা হয়ে ওঠে ক্রোধোত্ত। শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চাতুর্য। তারই অংশ হিসেবে প্রবর্তন করে পুরস্কার। পুরস্কার প্রদানের নিয়মটিও বেশ কৌতুকসর্বস্ব। আপনবৃত্তের নিকৃষ্টকে সমকালীন সাহিত্যের উদ্ধারকর্তা বলে প্রচারসহ পদক বিতরণেনর ব্যবস্থা থাকে সেখানে। সে পদক বিতরণের কার্যকারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্তাবকদল লালন করে এসব ছোট কাগজ। স্তাবকদের কাজই হলো সম্ভাব্যপদকযোগ্য অপচিন্তার স্তুতি করা। তারা ভুলে যায়, ‘লাগে না পদক খ্যাতি যদি থাকে লেখার শ্রাবণ’। এ পদক নিয়ে আরও পরিহাসপূর্ণ কাজ রয়েছে তাদের- পদকবিনিময়। তাদের দুই দলের নাম হতে পারে, প্রলুব্ধক ও স্তাবক। প্রলুব্ধক স্তাবক দলের কাউকে পুরস্কৃত করলে, স্তাবক দল দ্বিগুণ সুদাসলে তা প্রত্যার্পণ করে। আরেক ধরনের প্রবণতাও আছে।

কিছু ছোট কাগজকর্মীর কাজ হলো- গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের মতো ঢাউস আকৃতির কাগজ করা। এ মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের সূত্র ধরে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের হিড়িক পড়ে। কত তুচ্ছ স্বার্থ চরিতার্থ করার হীন মানসিকতা যে থাকতে পারে, এসব কাগজ পাঠ করলেই তা টের পাওয়া যায়। বিশেষ সংখ্যায় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রচারের মোহটিও বেশ ফলাও করে প্রকাশ করে। ফলে বুঝতে বাকি থাকে না, বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের উদ্দেশ্য কী! মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের লেখকেরাও নির্বাচিত। সম্পাদকীয়তে রাজা-উজির মারার বুলি কপচাতে-কপচাতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাসুন্দি লিখে রীতিমতো অভিসন্দন্ধর্ভও প্রণয়ন করেন। আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে গিয়ে দৈনিকের শ্রাদ্ধ করতেও ছাড়েন না এসব কাগজের সম্পাদকেরা। অথচ বিশ হাজার টাকার কাগজ করতে গিয়ে বিজ্ঞাপন বাবদতই সংগ্রহ করেন, লাখ টাকার ওপরে। এ বিজ্ঞাপনগুলোও বহুজাতিক কোম্পানির করুণাভিক্ষা ছাড়া মেলে না। তাহলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ কী? এ ধরনের প্রবণতা রাজধানীকেন্দ্রিক ছোট কাগজগুলোর ক্ষেত্রে ঘটে বেশি। এখন প্রশ্ন হলো, ছোট কাগজ যদি নতুন সাহিত্যের সূতিকাগারই হবে, তাহলে বিশেষ সংখ্যায় গবেষণাসর্বস্ব রচনা প্রকাশের উদ্দেশ্য কী? অধিকাংশ ছোট কাগজ সম্পাদকই নিজে ছন্দ না জেনেই স্লোগান তোলেন ছন্দউচ্ছেদের। আঙ্গিক-প্রকরণে অনভিজ্ঞ, আহাদ দেখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার। এখন যত কবি, তত কাগজ, তত সম্পাদকও। পাঠকের দেখা মেলা ভার! একসময় ছোটকাগজ করতেন সাহিত্যপ্রেমীরা, এখন করেন ধান্ধাবাজরা।

আগে ছোটকাগজ সম্পাদকের উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র সাহিত্যসেবা, এখনকার উদ্দেশ্য মূলত অর্থোপার্জন। এখন প্রশ্ন, কারা লেখেন ছোট কাগজে? সরাসরি উত্তর হতে পারে, যারা সম্পাদক, তারা একের কাগজে অন্যে লেখেন। এ প্রকারে সম্পাদকে-সম্পাদকে আঁতাত চলে। এক সম্পাদক অন্য একটি কাগজকে বিশেষ মূল্যায়নের দৃষ্টিতে দেখলে, সে সম্মানিত সম্পাদকও পাল্টা তোষামোদি করেন। আবার পরস্পর দ্বন্দ্বেও লিপ্ত থাকতে দেখা যায় বিভিন্ন ছোট কাগজকে। একটি ছোট কাগজকে ঘিরে একটি গোষ্ঠী যখন কোনো বিশেষ মতবাদ বা চিন্তার পরিচর্যা করে, অন্য একটি ছোট কাগজ তাকে অস্বীকার করে ভিন্ন কোনো ধারাকে পরিচর্যা করে এবং অন্যদেরও পরিচর্যার প্ররোচনা দেয়। শেষ পর্যন্ত ছোট কাগজ-বড় কাগজ বিতর্ক অনর্থক। প্রত্যেক মাধ্যমই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও সার্থক। অংশত বৃত্তাবদ্ধও। সুসম্পাদিত হওয়ার পরও। সুসম্পাদনার জন্য হৃদয়ের ঔদার্য, সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণ ও বাঁক বদলের ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা থাকা জরুরি। এর ব্যতিক্রমে কাদা ছোড়াছুড়ি, আত্মকলহ, আত্মপ্রেমই বড় হয়ে ওঠে।

পূর্ব প্রকাশ: অনুস্বার

মন্তব্য: