সুজিতের ছায়াহীন দিনগুলাে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

তুহিন দাস

-সুজিতের ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েটি সরাসরি সমুদ্রের কাছে যায়।

-নাে বকোয়াস।

-সমুদ্র মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করে ছিলাে।

-আর এই যে কাগজের মেঘ ভাসে তা হবার কথা ছিল না।

-ছেলেগুলাে ছাতিমতলায়ই অপেক্ষায় থাকে।

-হতে পারে, আবার এমন নাও হতে পারে।

-কোনাে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি কি বেরিয়েছিলাে?

-সবাই কি পৃথিবীর জন্য জরুরী নাকি?

-হয়তাে তার মূল্য ভার্চুয়াল গার্লের চেয়েও কম।

-তােরা একটা মঞ্চনাটক দেখেই আঁতলামি শিখে গেছিস। কী শক্ত শক্ত বলছিস!!

-তবুও আমার ধারণা ঠিকই, এ মেয়েটিই সুজিতের ঘর থেকে বেরিয়েছিলাে, আমি তখন বিন্দ্রাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, ওর রঙবেরঙের ফুলে সাজানাে জানালার দিকে তাকিয়ে মনে মনে চুটকি বানাচ্ছিলাম, বিন্দ্রা আমায় ডাকছিলো মৃদুস্বরে হিসহিস করে, …অজিত, ও অজিত…’,

এ কথা বলে অজিত একটি প্রজাপতির ডানা দুটো ছিঁড়লাে। দেখে আমি আতকে উঠি। মনে মনে প্রাথমিক একটি গল্প সাজিয়ে নিলাম। কিছু সত্য কিছু কল্পনা মিশিয়ে দারুণ একটা গল্প হতে পারে, এবং সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি সুজিতের সঙ্গে দেখা করবাে, তার কাছে জানতে চাইবাে মেয়েটি কে এবং কাথায় গিয়েছিলাে, কেনই বা সমুদ্রে নিজেকে ডুবিয়েছিলাে মরণজ্বরে। সাধারণত এ রকম ঘটনার পেছনে সাধারণ কিছু গল্পই থাকে, একটু ভিন্ন এঙ্গেলে তাকালেই সেসব গল্পগুলাে-ঘটনাগুলাে সমকালের সূত্রমুখ হয়ে উঠতে পারে – যা আমাদের বেদনাকে সামনে নিয়ে আসবে।

কিন্তু সুজিত কে? তা আমি জানি না। এ পাড়ায় সুজিত একাধিক থাকতে পারে। তাতে কি? ওদের কারাে কাছে জানতে চাইলেই তাে হয়। পাঁচজনের দলের মধ্যে পাঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি ছেলেকে দেখলাম বেশ অন্য রকম। ওদের সঙ্গে ঠিক মালে না। একটু বেশি চুপচাপ-বিষণ্ন-মাথায় সিথি করা। ওর কাছে জানতে চাইবাে ভাবলাম, কেননা ইতােমধ্যে ওদের আড্ডা ভেঙে গেছে। সবাই যে যার বাড়ির দিকে ফিরছে। রাত সাড়ে দশটা।

ছেলেটি আস্তে আন্তে হাঁটতে শুরু করলাে। পথচারীর ভঙ্গিতে অনুসরণ করলাম। ওদের থেকে আমরা বেশ খানিকটা দূরত্ব পেরিয়ে এলে ছেলেটিকে কি বলে থামানাে যায় ভাবছি। দেয়াশলাই চাইবাে? আরেকটা পন্থা আছে, প্রথমেই ওকে সুজিত বলে ডাকা। তাহলে হয়তাে ভড়কে সুজিতের ঠিকানাটা বলে দেবে। কোনাে সন্দেহ করবে না তাে? গােয়েন্দা ভাববে? মেয়েটা যে সুইসাইড করলাে, কন করলাে বা মেয়েটি আসলে কে, সে কিনারা করতে এসেছি ভাববে নাকি?

ছেলেটি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। বিশেষ করে পেছন দিকে। আমায় দেখে ফেললাে না তাে! এখন তাকে হারিয়ে ফেললে আর তাকে খুঁজে পাবাে না, তাই দ্রুত হেঁটে তার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট বার করলাম পকেট থেকে। ম্যাচ চাইবাে, তখনি সে উল্টো ঘুরে একটা একতলা ঘরের সামনে গিয়ে কয়েকবার চাপাস্বরে ডাক দিলাে :..সুজিত, সুজিত…। অমনি ঝপ করে এ পাড়ায় বিদ্যুৎ চলে গেলাে।

দরজাটা খুললাে। ঘরে কোনাে আলাে জ্বলছিলাে না। এইমাত্র লােডশেডিং শুরু হয়েছে। আর যে ডেকেছে সে তাে তার চেনা। অন্ধকারে সুজিতের মুখটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। অমাবস্যার রাত। দরজাটা বন্ধ হলো। আর কোনাে টু-শব্দও শােনা গেলাে না, আমি আনেকক্ষণ কান পেতে ছিলাম দরজায়। তারপর বাড়ি ফিরে এসে গল্পটা লিখতে আরম্ভ করলাম।

কিন্তু আমি হাল ছাড়তে চাইলাম না। গল্পটিকে নিজের মতাে করে শেষ করতেই পারি, কিন্তু আমার কৌতুহল দমে যায়নি, তা আরাে তীব্র হয়ে উঠেছে ঘটনাটি কি জানার জন্য।

আবার পরদিন সকালে ফিরে এসে দাঁড়ালাম একতলা ঘরটির সামনে। ঠিক তার বিপরীত পাশেই বিন্দ্রাদের দোতলা বাড়ি। একটা জানালা ফুলে-ফুলে ছেয়ে আছে, নিশ্চয়ই ওর, অজিত বলেছিলাে। একটু দূরে অজিতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম।

আমি খুব স্বাভাবিকভাবে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, যেন কারাে জন্যে অপেক্ষা করছি। প্যান্টের ময়লা ঝাড়ার ভান করলাম। পকেট থেকে নষ্ট ঘড়ি বের করে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। মানিব্যাগ খুঁজে খুঁজে ভিজিটিং কার্ডগুলাে দেখলাম। মােবাইলে নেট ব্রাউজ করলাম। সিগ্রেটের প্যাকেট পকেটেই ছিলাে। একটা প্যাকেট পকেটে সব সময় থাকে। ওতে থাকে একটা সিগ্রেট। জ্বালিয়ে খুব আস্তে আস্তে টেনে দু’হাত পকেটে, দাঁড়িয়ে থাকলাম রাস্তার পাশে, সাধারণত আমি যেভাবে শীতকালে সন্ধ্যার পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেই। সিগ্রেটের খালি প্যাকেটটা ফেলে দিইনি, পকেটেই রাখলাম ফের।

এই যে এতােক্ষণ দাঁড়িয়ে আমি, সুজিতের ঘরের দরজা এখনাে আটকানাে, জানালাও। দরজায় তালা নেই। ঘুমােচ্ছে নাকি, ভাবতেই হঠাৎ খুললাে দরজা। একজন মাঝবয়সী লােক ঘর থেকে বেরিয়ে এলাে। এই কি সুজিত? সে আমার থেকে কিছুটা দৃরে, ফুটপাতে কার্ডফোনের বুথ থেকে কোথাও ফোন করলাে। শুধু শুনতে পেলাম, “…সুজিত বলছিস,..? আর কিছু শােনা গেলাে না, একটা ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে ওর বাকী কথা উড়িয়ে নিলাে। আমিও পকেটে থেকে ফোনকার্ড বের করে বুথের কাছে দাঁড়াতেই সে বেরিয়ে হেঁটে সােজা ঘরে চলে গেলাে। বুথে ক্রেডল কানে লাগিয়ে দেখি অজিত ও বিন্দ্রা এদিকেই তাকিয়ে আছে। কতােক্ষণ পরে হেঁটে চলে এলাম ঐ পাড়া থেকে।

এবার কিন্তু অজিত আমার পিছু নিয়েছে। অজিত অনেকক্ষণ পর বুঝতে পারলাে একটা গােলচক্কর বারবার ঘুরছি, অর্থাৎ বুঝতে পেরেছি, ও তখন ফুটে গেলাে। কতােক্ষণ পর ফিরে এলাে বন্ধুদের নিয়ে। এই রাস্তাটা তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমায় কোথাও দেখতে পেলাে না। ঘরের পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের দেখলাম।

সন্ধ্যাবেলা সুজিতের ঘরটির সামনে আবার দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। তারপর সরাসরি কড়া নাড়লাম। কেউ সাড়া দিচ্ছে না। আবার জোরে জোরে কড়া নাড়লাম। এবার ভারী গলায় কেউ জানতে চাইলাে, ‘কে?

‘আমি’ – বললাম, কেননা এ ছাড়া আমার আর কোনাে পরিচয় নেই।

– আমি কে?

খুব শব্দ করে দরজা খুললাে। সেই লােকটা দাঁড়িয়ে, যে সেদিন বিকেলবেলা টেলিফোন বুথ থেকে কাউকে ফোন করেছিলাে, আর বলছিলাে সুজিত বলছিস… লুঙ্গি ও স্যান্ডো গ্যাঞ্জি পরা।

-কাকে চাই?

সুজিত-কে?

সুজিত? সুজিত কে?

-সুজিত বাসায় আছে? ডেকে দিন না?

-এখানে সুজিত বলে কেউ থাকে না।

-মানে? আমি অনেক কষ্ট করে ঠিকানা জোাগাড় করে এসেছি।

-আপনাকে কেউ ভুল ঠিকানা দিয়েছে। এখানে সুজিত বলে কেউ নেই।

-সত্যিই আশ্চর্যের ব্যাপার।

-আশ্চর্যের ব্যাপার বৈকি! অফিসের ফাইলপত্র বাড়িতে এনেছি, আমায় কাজ করতে হবে, রাতে বিদ্যুত থাকে না…

-বিরক্ত করলাম, আসি….। বলে, আমি তড়িঘড়ি করে ফিরে আসি, শুনতে পেলাম ভদ্রলােক বলছে, ‘আরে, আপনার পরিচয়টা তাে বললেন না…। বিন্দ্রার জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলাম । বিন্দ্রা কার সঙ্গে যেন মুঠোফোনে কথা বলছে আর এদিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছে।

যে জায়গায় অজিত ও তার বন্ধুদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম এই গল্পের শুরুতে, ঠিক সে জায়গাটায় এলাম। অজিত আর বন্ধুরা দাঁড়িয়ে, সেই পাঁচজন। আমাকে দেখে ওরা এগিয়ে এসে ঘিরে ধরলাে। শুধু সিঁথি করা ছেলেটা আস্ত আস্তে উল্টো দিকে হেঁটে গেলাে। সে যেন আলােহীনতার মধ্যে প্রবেশ করলাে, কিছুক্ষণ পর আর তাকে দেখা গেলাে না। আর ওরা চারজন আমায় মারতে শুরু করলাে।

-না- না, আমি সুজিতের খোঁজে এসেছি।

-বিন্দ্রার সঙ্গে প্রেম করতে চাও, তােমার হাড্ডি গুঁড়াে করে কুকুর দিয়ে খাওয়াবাে।

-আমি একজন লেখক।

-সাংবাদিক?

-তাতে কি, মার? আমার গার্লফ্রেন্ডর দিকে তাকানাে

-সুজিতকে খুঁজছি, সুজিত-সুজিত…।

ওরা একে অন্যের দিকে তাকালাে। আমি রাস্তায় পড়ে মার খেতে খেতেও বলতে লাগলাম,

-যে মেয়েটার লাশ পাওয়া গেছে সৈকতে, সে নাকি সুজিতের ঘর থেকে বেরিয়েছিলাে…

-শালা, আমরা যে নাটক দেখেছিলাম, ওটা দেখে এসে আমাদের সঙ্গে নাটক করছে।

ভিড় জমতে শুরু করেছে। দূর থেকে একটি হুইসেল শােনা গেলাে।

– এই পুলিশ আসছে, চল-চল..।

ওরা দ্রুত হেঁটে চলে গেলাে। পুলিশের গাড়ি নয়, একটি এমুলেন্স এ রাস্তা ধরে গেলাে। আমি তখনাে রাস্তায় বসে, জামা ছেঁড়া, ঠোঁটের কোণে রক্ত গড়াচ্ছে। কেউ এগিয়ে এলাে না। সবাই দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাে। আমার তখনাে ঘাের কাটেনি। সুজিত বলে কেউ নেই? তবে যে ওরা সেদিন আলাপ করছিলাে। ওরা কি অজিত বলছিলাে? সুজিত কি ওদের দেখা মঞ্চনাটকের নায়ক? সেখানেই এই গল্প শুনেছিলাে? না-না, তা নয়। না, তা হতে পারে না, আমার গল্পটা…!

রাস্তার অপর পাশে একটি মেয়ে কাকে যে ডাকছিলাে …সুজিত, সুজিত…, চমকে সেদিকে তাকিয়ে দেখি একটা বাচ্চা, এতাে সে সুজিত নয়। এবার ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। কৌতুহলী দাঁড়িয়ে যারা আমার মার খাওয়া দেখছিলাে তারাও যে যার গন্তব্যে এবার চলে যায়। আমি আমার ঘরের দিকে যেতে থাকি। কখন যে ওদের দলের সিঁথি করা ছেলেটি অন্ধকার ফুড়ে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখছে। কতােক্ষণ পরে টের পেলাম সে আমাকে অনুসরণ করছে। ওকে কাটিয়ে দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে ঘরে ফিরে এলাম। হাতমুখ ধুয়ে আয়নায় কেটে যাওয়া মুখের জায়গাগুলাে কয়েকবার ছুঁয়ে, রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ি বিছানায়, সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম। আর দেখতে শুরু করলাম স্বপ্ন।

ঐ ছেলেটাই আমাকে ডাকছে, …সুজিত, সুজিত…’, আর আমি বলছি, আমায় ও নামে ডাকছাে কেন? সে কেবলই জরাগ্রস্তের মতাে বলছে, আমরা সবাই সুজিত, মেয়েটি আমাদের সবার ঘর থেকে বেরিয়ে সমুদ্রে ডুবে মারা গিয়েছিলাে।

******************************************************

আজ ভােরবেলা দরজার কাছে মাটিতে পিনআপ করা পাঁচটি এ ফোর সাইজের কাগজ কুড়িয়ে পাই, কেউ ওগুলাে দরজার নিচ থেকে রেখে গেছে। তাতে লেখা ছিলাে উপরের গল্পটি, রুলটানা কাগজে, ঝকঝকে হাতের লেখায়। ঠিক বুঝতে পারছি না, এভাবে লিখে কে রেখে গেলাে! 

গতকাল রাতে দশটা পর্যন্ত আমার লিখিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছােটগল্প ও তার আঙ্গিক নিয়ে বেশ আলাপ হয়েছিলাে, যে যার মতাে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলাে, আমি কবিতা লিখি বলে তেমন কিছু বলিনি।

কি এখন এই লেখাটি নিয়ে কি করবাে? যে লিখেছে তার নাম জানি না। তার ভাষা আমার কোনাে লিখিয়ে বন্ধুর সঙ্গেও মেলে না। তবুও ভেবেছি, সুজিতের ছায়াহীন দিনগুলাের গল্পটি আমার নামেই পত্রিকায় ছাপতে দেব।

মন্তব্য: