আবুল হাসানের কবিতা : নিঃসঙ্গ পাথরের লাবণ্য

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

তুষার প্রসূন

আত্মপ্রকাশের অদম্য তাড়না থেকে মানুষের ভেতরে জন্ম নেয় বহুবিধ ভাবের। ভার প্রকাশের ইচ্ছা যখন ডানা মেলতে থাকে তখন প্রকাশের পথে বহুবিধ বাধা আসে কেননা তার ইচ্ছাগুলাে বহুমুখী। নির্ণয় করতে পারে না সে মূলতঃ কি বলতে চায়। প্রকাশিত কথার বা লেখার প্রতি শুরু হয় হিনমন্যতা, দ্বিধা থেকে এভাবে শুরু হয় শুন্যতাবােধ। শুন্যতা থেকে আত্মপ্রকাশের ভাবনা তীব্রতর হয়। মানুষ বুঝতে পারে সে নিঃসঙ্গ হলেও অস্তিত্বশীল। অস্তিত্ব রক্ষায় তার মনের গহীন থেকে উঠে আসে সত্যাসত্য বােধ। নিজেকে আর আটকে রাখা যায় না মনের হিমঘরে। এত মানুষ পৃথিবী জুড়ে তবু কি যেন নেই, কে যেন নেই। কেন এমন হবে শুন্যতার পথ বেয়ে নিঃসঙ্গতার ধরণ? এমন সুপারকমপ্লেক্স স্নায়ুয়ুকোষে চাপ ফেলে। প্রভাবিত হয় আঙুল, নড়ে ওঠে কলম। মনের গহীন থেকে উত্থিত হয়ে লেখা হয় একের পর কথা, কবিতা, আত্মআবিষ্কারের নেশায় কবি লেখেন-

সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র,

                                    মায়াবী করুণ

এটা সেই পাথরের নাম নাকি? এটা তাই?…

আমি বহুদিন একা একা প্রশ্ন করে দেখেছি নিজেকে,

যারা খুব কাছাকাছি থাকে, যারা এঘর ওঘরে যায়

সময়ের সাহসী সন্তান যারা সভ্যতার সুন্র প্রহরী

তারা কেউ কেউ বলেছে আমাকে-

এটা তাের জন্মদাতা জনকের রুগ্ন রূপান্তর,..

(আবুল হাসান /রাজা যায় রাজা আসে)

পৃথিবীতে স্বল্পকালীন ঘুরতে আসা এই নিঃসঙ্গ পরিব্রাজক আবুল হাসান। চিত্রশিল্পী হলে হয়ত আত্মপ্রতিকৃতি এঁকে ফেলতেন কিন্তু তিনি আত্মজীবনীর রসধারায় নিজস্ব নাম ব্যবহার করে লিখেছেন কবিতা।

আলাে-বাতাসের যাওয়া-আসার যেমন বিশেষ কোনাে পথ নেই তেমনি কবিতা কোন পথ বেয়ে চড়াও হবে মানবদেহের পথ ধরে মনের অন্দরমহলে তারও কোনাে নির্ণিত দিক নেই। কবিতা কোন বয়সে পুষ্ট হয়, কোন সময়ে সার্বজনীন হয়ে ওঠে তারও নেই কোনাে বিশেষ দিনক্ষণ। সারাজীবন কাঠ খড় পুড়িয়েও কেউ কেউ আসল লক্ষ্যে পৌছতে পারে না আবার কেউ কেউ অল্প লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসে জায়গা করে নেন, এমন খবর বিশ্বসাহিত্যেও কম নয়, সেক্ষেত্রে জন কীটস্ এবং সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা স্মরণযােগ্য। বাংলাদেশে আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫) তেমনি একজন যার জন্মসন তুলে নিলে কবিতা পড়ে তার বয়স অনুমান করা দূরুহ হয়ে ওঠে। যাট-এর দশক অর্থাৎ মাত্র এক দশক তিনি কবিতা চর্চা করে যথেষ্ট মৌলিকতার ছাঁপ রেখে গ্যাছেন। তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে জীবনানন্দীয় ছায়া মনে হতে পারে কিন্তু তিনি আত্মসচেতনতা দিয়ে সেটাকে জয় করেছেন। তার কবিস্বত্তা এতটাই দৃঢ়। ব্যক্তিগত হতাশা, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক বেদনাবােধের সাদাকালো আলােকসজ্জায় তিনি সাজিয়েছেন তার কবিতা। তার প্রকাশিত তিনটি বই এবং অপ্রকাশিত (দেহত্যাগের পরে প্রকাশিত) কবিতা পাঠে বােঝা যায় নিঃসঙ্গতার স্বরূপ। তিনি অতৃপ্ত থেকেছেন কবিতার সমগ্র জুড়ে, সমাজ যেন মুখােশ পরে ছিলাে তার সময়ে যেমন এখনও আছে। নেতৃস্থানীয়দের মুখে আশার বাণী, বাস্তবে হতাশার হাতছানি। নির্মমতা অক্টপাশের মতাে আটকে রেখেছে। তিনি যে পথে যেতে চেয়েছিলেন বাস্তবতা প্রতিদিনই তার উল্টো পথে হেটেছে। শৈশবে তিনি দেখেছেন নিসর্গের খেলা, পরিণত বয়সে থেকেছেন ঢাকায় দেখেছেন নাগরিক জটিলতা। ফলে গ্রাম ও নগরের উপলব্ধিজাত বিষয় তার কবিতায় স্থান পেয়েছে। কবি শামসুর রাহমান তার একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন তার এই বন্ধুর কথা, বলেছেন- ‘আবুল হাসান বিষতা, নৈসঙ্গ্য ও দীর্ঘশ্বাসের কবি।’

আবুল হাসানের শিল্পমানস তীক্ষ্ণ। কবিতায় নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য সৃষ্টিতে তিনি অনেক কারুকাজ রেখে গেছেন। ভালােবাসা ও মমতা দিয়ে তিনি যে মানুষকে জয় করতে চেয়েছিলেন তার ছাপ তিনি কবিতায় রেখে গ্যাছেন। আবুল হাসান সম্পর্কে কবি ও সমালােচক আবু হেনা মােস্তফা কামাল যথার্থই বলেছেন, চুড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করলে তাঁর ভেতরে মায়া ও মমতা, মানুষের জন্যে দুঃখবােধ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। আবুল হাসান বুঝতে পেরেছিলেন দুঃখ পাওয়া মানুষগুলাে ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। তাই তিনি মানুষের দুঃখকে নিজের ব্যক্তিগত আয়নায় দেখে নিয়ে মানুষকে কষ্টের ভার থেকে নিস্কৃতি দিতে চেয়েছিলেন। লিখেছেন-

উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা হে দুধভাত তুমি ফিরে এসাে!

মানুষের লােকালয়ে ললিতলােভনকান্তি কবিদের মতাে

                                         তুমি বেঁচে থাকো

তুমি ফের খুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!

রমণীর বুকের সনে আজ শিশুদের দুধ নেই প্রেমিক পুরুষ তাই

                            দুধ আনতে গ্যাছে দূর বনে।

শিমুল ফুলের কাছে শিশির আনতে গেয়ে সমস্ত সকাল।

সূর্যের ভেতর আজ সকালের আলাে নেই, সবাসাচীরা তাই

                               চলে গেছে, এখন অকাল,.

(উদিত দুখের দেশ, যে তুমি হরণ করাে)

কবিতা চর্চার প্রাথমিক দিকে তিনি নির্মোহ সন্তের মতাে কিভাবে যেন সমাপ্তিরেখা টেনে নিয়ে বলেছেন-

অবশেষে জেনেছি মানুষ একা।

জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!

দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন।

(পাখি হয়ে যায় প্রাণ, রাজা যায় রাজ আসে)

ঢারিদিকে মানুষের চল। তাও যেন মুখােশপরা মানুষ। তিনি সেখানে নিজেকে খুঁজে পেতে চান। ফলে আমি ও আমিতবের বজ্ তব হয়ে ওঠে। মানুষকে নিয়েই মানুষ থেকে দূরে থাকতে চাওয়ার এই যে আকাঙ্ক্ষা তা আমৃত্যু তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন-

কথা ছিলাে তিনদিন বাদেই আমরা পিকনিকে যাবাে,

বনভূমির ভিতরে আরাে গভীর নির্জন বনে আগুন ধরাবাে,

আমাদের সব শীত ঢেকে দেবে সূর্যাস্তের বড় শাল গজারী পাতায়।

(বনভূমির ছায়া, রাজা যায় রাজা আসে)

একাকীত্বের প্রতীকী রূপ দান করে কবি যান্ত্রিকতা থেকে নিজেকে দূরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। বন্ধু-বান্ধব-পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, রাষ্ট্র সবই এখন বিচ্ছিন্ন। বিশ্বাস পরাস্ত। ব্যাধিতে আক্রান্ত সমাজকে দেখতে দেখতে তিনি ফুসফুসের হাওয়া ফুরিয়েছেন।

আবুল হাসান সত্যি সত্যিই একা হয়ে গেছেন কিন্তু আমাদেরকে নিঃসঙ্গ হতে দেননি। প্রতিদিন আমাদের সঙ্গ দিয়ে চলেছেন তার কবিতার মাধ্যমে। মাত্র ২৯ বছর বয়সের ছােট্ট জীবনে কাব্য চর্চার ধারাবাহিকতায় তার একাকীত্ববােধ তীব্র হবার কারণ বােঝা যায়, আর

তা হলাে তার অনুভূতিপ্রবণ মন। এখন পারিনা কবিতায় তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, ‘দেখেছি দুঃখের চেয়ে সুখ আরাে বেশি দুঃখময়’। কবি এখানে নিজেকে পুড়িয়ে খাঁটি করতে চেয়েছেন নিজেকে, কবিতাকে। এভাবে তিনি হতাশার কারণ খুঁজেছেন এবং তা থেকে উত্তরণের পথ নিয়েও ভেবেছেন। ক্রম পরিণতীর দিকে অগ্রসর হতে হতে তিনি লিখে ফেলেছেন দুঃখ পেয়েও আশা নিয়ে বেঁচে থাকার কবিতা। নিঃসঙ্গতা থেকে তিনি শক্তি সঞ্চয়ের এক অসীম প্রেরণা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে রেখে গ্যাছেন। লিখেছেন-

ঝিনুক নীরবে সহাে

ঝিনুক নীরবে সহাে, ঝিনুক নীরবে সহে যাও

ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে মুক্তো ফলাও!

[পৃথক পালঙ্ক, ঝিনুক নীরবে সহাে)।

আবুল হাসানের কবিতা বহুমাত্রিক নন্দনতনত্ত্বে বিধৃত। পৃথিবীতে একজন কবিকে যিশুর মতাে সহনশীল হতে হয় তা তিনি বুঝেছেন, বুঝিয়েছেন। ঝিনুকের মতাে বিষের বালি বুকে ধারণ করে জন্ম দিতে হয় মুক্তা, শিল্পে উত্তীর্ণ করতে হয় কবিতা। নিঃসঙ্গতার এক শৈল্পিক রূপায়ণ হয়ে আবুল হাসানের কবিতা দ্যুতি ছড়ায় আজো আমাদের এই আটপৌরে জীবনের উঠোনে, নিঃসঙ্গ পাথরে এনে দেন নন্দনতাত্ত্বিক লাবণ্য।

মন্তব্য: