আবুল হাসান : আদিম উদ্যানের নিঃসঙ্গ পরিব্রাজক

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শহীদ ইকবাল

‘যাকে আমরা মানুষের নীল দীর্ঘশ্বাসের কবি বলে জানি, তিনি ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন মােমবাতি। যারা দুরন্ত ঝড়ের মতাে আসেন আর তারা দ্রুত ধাবমান অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতাে নিভে যান।… শেলী, কীটস, রিস্তোসির্নেনস্কি, সুকান্ত ভট্টাচার্য, আবুল হাসান কারােরই বয়স ত্রিশাের্ধ্ব নয়। পৃথিবীর অকালপ্রয়াত কবিদের তালিকায় কবি আবুল হাসানের নামও স্থান পেয়েছে।’ আবুল হাসানের জন্ম ১৯৪৭র আগস্ট মাসে গােপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বর্ণিগ্রামে। শৈশব তার কবিতায় বড় স্থান দখল করে আছে। ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকে লেখালেখি শুরু, ১৯৬৬ পর্যন্ত লিখতেন আবুল হােসেন নামে, পরে অগ্রজ কবির নামবিভ্রাট এড়ানাের জন্য রফিক আজাদের উপদেশ ধারণ করে আবুল হাসান নামাঙ্কিত হন। ‘আর কী আশ্চর্য, নাম বদলানাের সঙ্গে সঙ্গে তার কবিতাও গেল বদলে। পুরানাের খােলস থেকে বেরিয়ে এলাে নতুন। কবিতার জ্বলজ্বলে প্রান্তরের দিকে তার যাত্রা শুরু হলাে।’ (শামসুর রাহমান) ‘গণবাংলা নামের একটি সংবাদপত্রের সাহিত্য-সাময়িকীতে সংশ্লিষ্ট ছিল কিছুকাল, বােধ হয় শহীদ কাদরীর সহকারী হয়ে, একটু রাত করে আসত আমার কাছে, লেখার জন্যে। শহীদ কাদরীর সমভিব্যহারেও কোনাে কোনাে রাতে আসত। কাজ করেছিল আরো কোনাে কোনাে সংবাদপত্রে সবই অল্পদিনের জন্যে। আমার নৈশ কলেজের অফিসকক্ষের হাসান হানা দিত মাঝে মাঝে। সবান্ধব, কখনাে একা। কতােনা রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছি আমরা… (আবদুল মান্নান সৈয়দ)। আবুল হাসান কবিতা ছাড়াও কিছু ছােটগল্প লিখেছেন। নয়টি গল্প নিয়ে আবুল হাসানের গল্পসংগ্রহ ১৯৯০-এ প্রকাশিত হয়। অপ্রকাশিত প্রায় সব কবিতাই মৃত্যুর পরে পুস্তক আকারে বেরিয়েছে। ১৯৭০-এ রােগ ধরা পড়ার পর নানা সময়ে অসুস্থতা এবং ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যু। মৃত্যুর পর আবুল হাসান বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেন।

২.

আমাদের কবিতায় ‘নিঃসঙ্গতার আইকন’ আবুল হাসান। ১৯৬৫-১৯৭৫ পর্যন্ত আবুল হাসান সাংবাদিক ও লেখকরূপে ঢাকায় বসবাস করেন। তখন কবিখ্যাতি কবিসমাজের (শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ প্রমুখ) নজরে আসে। আবুল হাসান স্বল্প সময়ে

বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিক রূপরীতির রচয়িতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।

শামসুর রাহমান বলেনঃ এই কবির জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কবিতায় ভরপুর ছিল। যেন হাওয়ায়, ধুলােয়, গাছের পাতায়, পাখির ডানায়, নদীর জলে, দিনের কোলাহলে, নিস্তব্ধতায় তিনি কবিতা পেয়ে যেতেন। তাঁর কবিতায় আত্মপ্রেম, নৈঃসঙ্গ্যবােধ, বিচ্ছিন্নতা কিংবা স্মৃতিকাতর বেদনার্ত আত্মা দিব্যত্ব অর্জন করে। কবিতাশরীরে অন্তহীন স্বপ্নচারিতা প্রবিষ্ট। স্বপ্নকাতরতায় মগ্ন কবিমন বাউল-বীক্ষণে প্রকাশিত, “পাখি হয়ে যায় প্রাণ” থেকে:

দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে

কেবল দিব্যতাদুষ্ট শােনিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বােঝাই মাঠে দেখি,

সেখানেও বসে আছে বৃদ্ষের মতােন একা একজন লোক,

যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি

শতজীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান!

পাখি হয়ে যায় প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত।

“আবুল হাসান” নামটি নিয়ে রচনাসমগ্র (প্র.প্র. ১৯৯৪) তে তাঁর প্রথম কবিতা, কাব্যের নাম রাজা যায় রাজা আসে (১৯৭৩)। ভূমিকাটি শামসুর রাহমানের। উপর্যুক্ত পংক্তিমালায় বৃক্ষ=একা একজন লােক, দেখেন কবি নিজেই (‘আমি’) যিনি প্রশ্নশীল এবং ‘অনিচ্ছুক দাস’। যেখানে ভালােবাসা খুব কাঙ্ক্ষিত কিন্তু তা অনেক দূর। কবির সময়খণ্ডে দৃঢ় অপরূপ সুন্দর, শুভপ্রদ। কবিতার-কাঠামােতে তা কালােত্তীর্ণ পেরােয় শতজীবন কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজপ্রবাহে সে ‘নিমনমানের মানুষ’। যে সময়ে আবুল হাসান সমাজ-মানুষের কাছাকাছি, তখন বাবা হয়ে গেছেন ব্যর্থ মানুষ, এ মধ্যবিত্ত পরিবারের নিজে নিরুদ্দিষ্ট বড় ভাইয়ের মতাে, আর দীর্ঘশ্বাসের সিদ্ধান্তে ‘মানুষ চাদে গেল, আমি ভালােবাসা পেলুম পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলােনা!’ এ অর্থে আবুল হাসান প্রভৃতরূপে ঘন সুন্দর নির্কুশ সত্যে দাঁড়াতে চান। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রসংঘ, রাজনীতিক প্রতিহত হয়ে চলে বৃষ্টিতে, দুঃখময়ী মাতৃভাষায়, প্রিয়ার চুম্বনে, মায়ের বাগানে, চামেলীর গন্ধে। রাজা যায় রাজা আসে কাব্যে সিদ্ধান্ত আসে ‘শান্তিকল্যাণ’-এর, ঠিক হয়ে যায় “নিঃসন্দেহ গন্তব্য”-র দিকচিহ্ন। এ কাব্যে প্রেমিক কবি, নৈঃসঙ্গ্য-পীড়িত-ক্লান্ত-দীর্ণ (“ক্লান্ত কিশাের তােমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়”)। কবিভাষাটি আবেগময়। কিন্তু নিজের দার্শনিক দৃঢ়তা অর্জিত, ব্যক্তিত্বমগ্ন। পূর্বজের প্রভাব মেলে, ষাটে পাশ্চাত্যচিন্তার ধারা স্থিত হয়ে যাচ্ছিল- সেটি এদেশের নির্মল প্রকৃতিতে এক ধরণের বাস্তবতার ভেতর দিয়েই গ্রহণ হতে থাকে, আবুল হাসান নিকট বন্ধুদের ভেতরদিয়ে বেড়ে উঠলেও নিজ পথে স্বচিন্তা ধারণ করে এগুতে থাকেন। শহীদ কাদরীকে উৎসর্গিত কবিতা “গাছগুলাে”, রফিক আজাদকে “অগ্নি দহন বুনাে দহন”, আবদুল মান্নান সৈয়দকে “শিকড়ে টান পড়তেই” আর নির্মলেন্দুর হাতে যে তুমি হরণ করাে দিয়ে দিলেন কিন্তু নিজ শক্তিটুকুতে যে অনন্য তা বুঝিয়ে দেন। ‘সর্বৈব মন্বস্তরের মধ্যে বসেও আবুল হাসান, ষাটের দশকের সবচেয়ে স্বপ্নপীড়িত কবি, স্বপ্ন দেখেছেন পূর্ণতার, পরিতৃপ্তির, স্বাস্থ্যের ও সম্পন্নতার। এ এক দুর্লভ ক্ষমতা, যে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত ছিলেন ষাটের অনেক কবি’। (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ)

যে তুমি হরণ করাে (১৯৭৪) কাব্যে আবেগ সংলগ্ন মেধায় আরও নান্দনিক, কবিভাষা নির্মিত। অভিজ্ঞতা প্রাচুর্যময় আত্মপ্রেম যুক্ত দেশপ্রেমে, রিল্কীয় রক্তক্ষরণের প্রাবল্য-মিশ্রিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মারী-মম্বন্তর অতিক্রমী পথভ্রষ্ট মানুষ- শেষপর্যন্ত জয়ীই সে :

উদিত দুঃখের দেশ তাই বলি হে কবিতা, দুধভাত তুমি ফিরে এসাে,

সূর্য হােক শিশিরের ভাের, মাতৃস্তন্য হােক শিশুর শহর।…

এইভাবে নতজানু হতে চাই ফলভারনত বৃক্ষের শস্যের শােভায় দিনভর

তােমার ভেতর ফের বালকের মতাে চের অতীতের হাওয়া

খেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চাই।

এর ভেতরে বিচ্ছিন্ন নয় ব্যক্তিসত্তা, বেড়ে ওঠে তাপিত বিষণ্নতা, অমােঘ অনুতাপ। কবির শব্দ-প্রতীক-উপমানচিত্র অধ্যাত্ম বিষপ্ন আভায় সৌকর্যমণ্তিত। “কবির ভাসমান মৃতদেহ”, “কুরুক্ষেত্র আলাপ”, “গােলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশাের”, “নিঃসঙ্গতা”, “নির্বিকার মানুষ”, “ভুবন ডাঙায় যাবাে” কাব্যের আকর্ষণীয় কবিতাগুলাের অন্যতম। তীক্ষ্ণ প্রতীকী আর দার্শনিক অভিপ্রেত পংক্তি ‘একটি ভিক্ষুক হাসতে থাকবে ভিক্ষুনীর অর্থকোল জুড়ে’, ‘দেখেছি দুঃখের চেয়ে সুখ আরাে বেশী দুঃখময়’। তবে এ কাব্যে নারী- ‘প্রণয়’ অপরূপ মাত্রা লাভ করেছে। আমি-তুমির পৌরাণিক আক্ষেপ-আস্বাদ চিরতরে ব্যঞ্জনা লাভ করে। কবি প্রেম-ব্যবচ্ছেদ বয়ে এনেছে কষ্টকাতরতা, অকৃত্রিম জন্ম-সৃষ্টির ভ্রমণময় অরূপ আলাপন, অশরীরী আদ্যোপান্ত জীবনরেখার ভেতরের ক্লান্তিধ্বনি। এরূপ আখ্যানের অবচেতন দ্বন্মময় প্রকাশরূপ আবুল হাসানে উন্নত মানের স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ রচনা করতে সক্ষম হয়েছে। এ প্রত্যাদেশে আনন্দের বৈপরীত্য থাকলেও তা নির্মল-শান্ত সুখকর, কারণকেন্দ্রের সৃজন তাে নারীর- যা বসুন্ধরাময় এবং ততােধিক যৌবনময় ।

(ক) আর ঐ যে অমৃত ঝর্ণা, ওকে কারা বুকে এনে অতটা স্বর্গীয় শব্দে

শ্রােতম্বিনী ডাকে।

(খ) আর সেই রমণীকে দেখে ফেলে একটি আদিম কালাে রাত!

আর সেই রমণীকে দেখে ফেলে নগ্ন মহিলা আর নগ্ন যুবতী!

আর সেই রমণীকে দাঁতে দাঁতে দীর্ঘতর করে তােলে তীব্র দংশন।

(গ) সমস্ত সতীর গাত্রে লাথি মেরে

      সমস্ত সৃষ্টির পাতও ভেঙে-চুরে

     এসাে হােক তােমাতে আমাতে

     এসাে ভয় নেই।

(ঘ) আজো শীতরাতে তুমি কুয়াশায় ক্ষুধিত চাদের মতাে বাঁকা কটিদেশ,

হায় তুমি, হায় অবিরাম রাতে ভেসে আসা উষ্ণ ছিপ নৌকা আমার!

কবির এ নির্ভার কথন, কল্পোক্তির অনুধ্যান নিশ্চিত করে মধ্যবিত্ত সত্তার ‘অন্ধকার’ অবয়বটি। সে লক্ষ্যে উপমান চিত্র উপমেয়, রূপকল্প, ইমেজ ইঙ্গিত পরিস্রুত হতে থাকে। যৌনতা আর জীবন রঙ অভিন্ন, অবসাদ-ক্লান্তি আর আনন্দও অভ্রান্ত, কিন্তু প্রশ্ন এ ব্যক্তির জীবন এমন কেন? এর শেষ ঠিকানাই বা কি? যে অকৃত্রিম প্রকৃতি ও নিসর্গে তার জন্ম, জন্মের পরে হারাতে বসে মাতৃকোল-বাগান-বাবা-ভাই পরে উত্তীর্ণ বয়সে প্রেমিকা, প্রেম আর অসুখময় সুখ। সেখানে সমাজ-রাষ্ট্র আরও বিধে দেয় নানারকম কষ্টতিলক। মুক্তি কী? কবির চিহ্নিত সময়ে কবিভাষার এ রূূপরেখাটি আরও উর্ধ্বগামী হয়ে পড়ে পৃথক পালঙ্ক (১৯৭৫)-এ এসে। উপনিষদ হয় উপলক্ষ। “মধ্যরাতে ঝাউকান্না কেঁদে বলে, শান্তি হােক, ওরে শান্তি হােক’- শান্তির বারতা শিল্পিত হয়ে ওঠে। মৃত্যু্ঞ্জয় রূপ পরিগৃহীত “নচিকেতা”য় ।

মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হােক। আমি মরি নাই- শােনাে

লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আত্মার জিভে জিভ রেখে 

শিশু যে আস্বাদ আর নারী যে গভীর স্বাদ সংগােপন শিহরণ পায়- আমি তাই।

শ্রেষ্ঠ এ কাব্যটিতে পূর্ণতা আসে কবির। সিম্ফোনিতে পূর্ণ প্রশান্তময়, বৃক্ষ-পক্ষী আবার ফিরে আসে তবে তা পুরনাে অর্থে নয়, শ্রেয়াে-তাড়নায়। সৌম্য তার রূপ। জেগে ওঠার প্রত্যয়। উঁচু মাপে ব্যাপক মহাজাগতিক অভীক্ষাটির উদ্ভাসন ঘটে :

শুধু এই নষ্ট জমি তােমাতে তােলেনা ধর্মি,

শস্যক্ষেত, বৃক্ষভূমি, মাটি ও মৃত্তিকা আজ

মরিতেছে অবক্ষয়ে ঘুণ ধরিতেছে।

অথবা,

বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হয় তােমার পায়ের পাতার শব্দ,

পাতার শব্দকে মনে হয় তােমার গাড়ীর আওয়াজ;

আমি চক্ষু সজাগ করি, কান উৎকর্ণ, ইন্দ্রিয় অটুট,

তুমি আসছাে না, তুমি আসছাে না

তােমার কত হাজার বছর লাগবে আসতে?

তুমি যখন নৃত্য করাে মুদ্রাগুলি কাপে

তােমার হাতের মধ্যে তাে নয় যেনবা কিংখাবে,

তলােয়ারের মতােন তুমি তােমার দুহাত তােলাে,

চোখের নীচের নগ্নতাকে ছন্দ পেয়ে ভােলাে।

আমি তখােন আমারে পােড়া দেশের পাপে মরি।

নিজের কাছে নিজের দেহ তীব্র তুলে ধরি।

এক্ষেত্রে শব্দ-নির্বাচন, নতুন উপমা ও অভিনব চিত্রকল্প নির্মাণে (গােধূলির মস্তিষ্কে রক্ত’, ‘জ্যোৎস্নার গাঙচিল’, দগ্ধ শ্যাওলার মতাে ছাইরঙা শার্ট, ‘সবুজ রং-এর শীত ইত্যাদি) দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। নিজের অন্তর্গত চেতনালােকে নির্বাসিত হন তিনি। সেখানে কীর্তিত হন ‘ভেজা মাটির বৃষ্টিতে কিংবা ‘পারদমাখা শয্যা’য়। এসবের ভেতরেই জীবন-মৃত্যুর বিপরীতাত্মক প্রান্তকে মেলে ধরতে চান কবি।

.

যাই, এখন তােদের শরীরে শস্যের আভা ঝরে পড়ছে যাই…

মৃত্যু আর মৃত্যু আর মৃত্যুর আঁধারে যাই,

বিবর্ণ ঘাসের ঘরে ফিরে যাই, যাই

সেখানে বােনের লাশ, আমার ভাইয়ের লাশ খুঁজে নিতে হবে,

                            আমি যাই

দেখি কারা দিকে দিকে দীর্ঘ মেঘে ঢাকা পড়ে আছে

দেখি, কোথায় সে জলাভূমি, কোথায় সে ট্রেঞ্চ, নালা,

                 ইটের নদীর তলদেশ আর

কোথায় সে নীলিমার নক্ষত্রবীথির শান্তি, সবুজ রং-এর শীত, দেখি

কোথায় কাহারা আজ এত উষ্ণ মৃত্যুতে স্থির, নির্যাতিত আলােয়

                                        স্থির

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-সম্বলিত এ কবিতায় কবি মৃত্যু-পংক্তির রূপময় পরিবেশ রচনা করেন। বিষণ্নতায় হন দগ্ধ। মৃত্যুচেতনা বিদ্যমান প্রকৃতিরাজিতে স্থির কম্পমান। পৃথক পালঙ্ক সে ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ। ত্রিশােত্তর কবিদের প্রভাব হলেও তা হাসানের হাতে অন্য। একটি আলােকিত কবিভাষা এক্ষেত্রে নির্মিত হতে দেখা যায়। কবিকণ্ঠটি পরিষ্কার। আগেই এ কাব্যের প্রথম কবিতা “নচিকেতা”র উদাহরণ এসেছে। তাতে ঘােষিত কবিস্বর। বিনষ্ট বা গলিত জীবনের আরােপিত ক্রন্দনে কাতর নন কিংবা পাশ্চাত্য স্বভাবে জাঁ আর্তুর র্যাবাে (Jean Arthur Rimbaud) বা লােরকার অনুভাবের প্রত্যক্ষ প্রেরণাবন্দি নন। যদিও বলতে শােনা যায় লােরকার বিষণ্ন জন্মর কথা। কিন্তু তা ব্যক্তি পরে দেশের পটচিত্রে, পরিশ্রুত বাঙালির ভঙ্গুর পীড়িত সমাজ-কাঠামােয়। আগের কাব্যে যেটি স্পষ্ট নামে প্রকাশিত গােলাপের নীচে নিহত হে কবি কিশাের”, “কবির ভাসমান মৃতদেহ”, “আমি অনেক কষ্টে আছি।” বিষণ্নতা ব্যাপক চিত্রে প্রতিফলিত। উপর্যুক্ত উদাহরণটির মতাে অনেক পংক্তিতে তা আইকনে পরিণত। সার্বভৌম এ আনুষ্ঠানিকতাটি পূর্বজ অনেক কবি লালন করলেও গভীর অনুভবের চর্চায় বা বিচিত্র বিষয়বস্তুর ভেতর দিয়ে |মৃত্যু, রােগ, নারীর জৈববস্তু (স্তন, যােনী, জরায়), মহামারী, মম্বন্তর তাকে আধারবন্দী করা অত্যন্ত নতুন। এটি প্রকৃতির বিচিত্র রঙে (বৃষ্টি, বৃক্ষ, নদী, পক্ষী) ব্যাপক। কবির টোটেমব্রতও যেন এ ধর্মটিকে অনেক প্রসারিত করে, যাতে মনুষ্যত্ব-মানবিক সারাৎসার রীতিমাফিক তার আদর্শে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে নারীর সত্তাগত সম্ভাবনা ও অধিকার চেতনাও অপরিস্ফুট নয়। তাবৎ মহিমার প্রকৃতি কাব্য-প্রকরণ ধারণ করলে আবুল হাসান নিজের ভেতরে নির্মাণ-পুলকে বা নবায়িত সৃষ্টিতে পৌঁছুলে তার প্রতাপটুকু বিস্ময়কর বলে স্বীকার করার কিছু থাকে না। কারণ, এ পথের বাকে এবার তার নব-প্রতিভার স্তর কায়েম হয়েছে, তার প্রকাশ উদিষ্ট পৃথক পালঙ্ক। এ কাব্যের প্রবণতা আত্ম-উৎসারণ। রোগশয্যা, স্মৃতিচিহ্ন, অসুখ, নরকের আগুন, রুগ্নতা, হাসপাতাল, মৃত্যু, এপিটাফ-এর ভেতর থেকে পুরাণের পাখির মতাে জেগে ওঠা। আত্মার এ জাগর-আখ্যান চিরজয়ী, মৃত্যুঞ্জয়ী, জয়শ্রী। আমার অনলে আজ জাগাে তবে হে জীবন, জয়শ্রী জীবন!”, “মধ্যরাতে ঝাউকান্না কেঁদে বলে, শান্তি হােক, ওরে শান্তি হােক!’, “সমস্ত শান্তি ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে মানুষের মনীষার শেষ বৈনাশিকে! এভাবে আত্মাকে অনলে পুড়িয়ে, ‘শান্তি-র চিরজীবিত শিল্পকাঠামাে রচনা করেন। এতে প্রকরণবৈশিষ্ট্যও নিরূপিত হয়। পুনরুদ্ধার বা রিভাইভ অনেকটা যীশু-পুরাণে-উপনিষদে প্রজ্বলিত। এ প্রজ্বলনের পথ জাগতিক সকল প্রাণীর শুভপ্রেরণায়। কিন্তু সেটি উজ্জীবিত হওয়ার সারণী সমাজ-বিধৃত অভাব, দুঃখ, বেদনা, গ্লানির ভেতর দিয়ে। কবি দুঃখ-বেদনারও কাব্যময় প্রসিদ্ধি নির্মাণ করেন। স্মৃতিসৌধে বা উদ্ধত-ভীতিকর প্রাণীবাচক বিশেষায়ণে তার শিল্পিত রূপ-কাঠামাে রচনা করেন। বাংলার প্রকৃতিতে কিংবা বিধৃত বিবর্তিত সমাজ ও জীবনচেতনায় তার পুনর্বয়ন লাভ ঘটে। সমাজের উপরকাঠামােয় প্রকাশিত যে স্তর তার কারণ হিসেবে ভেতরের কাঠামাে ও কার্যকারণ সম্পর্ক, কর্পোরেট বা মার্কেন্টাইল বাণিজ্যের শাসনে নিপতিত ব্যক্তি, যে জন্মেই কুঁকড়ে গেছে, ব্যথাদীর্ণ ক্ষয়িষ্ণু মন ও মনন, প্রেমবিনাশী ও দুর্বিনীত দ্বন্দ্বে সৃষ্ট ক্ষত আর দুঃখচিহ্নিত প্রহরের গরল নিয়ে তবুও জয়ী জীবিতের শান্ত-সন্ধান প্রচেষ্টায় রত কবির উপলব্ধ প্রকরণ। ছন্দও সে লক্ষ্যেই সচেষ্ট। এ শান্তির ইমেজ রূঢ়-বিদ্রপাত্মক-বিকৃত-কঠোর কিন্তু শেষাবধি উপনীত শান্তি পারাবারে। তৃতীয় এ কাব্যটিতে পূর্বের কাব্যচিন্তনের সরণী বেয়ে কবি পৌঁছেছেন দুর্লভ শান্তি পারাবারে। যেখানে নিজস্ব রূপ-ধারণাটি পূর্ণ ও জীবনজয়ী মানুষের সারাৎসাররূপে চিহ্নিত। বিভাগােত্তর কাব্যভাবনায় এর স্বরূপ পার্থিবতার ভেতর দিয়ে লােকোত্তর বিশেষত্ব লাভ করতে সক্ষম হয়। “মৃত মানুষের পুনরুথানে যে নবজন্ম তা বৃষ্টি, নদী, সমূদ্র, রৌদ্র কিংবা গােলাপ, কোমল হরিণ রূপকে প্রকাশিত। এ রূপকার্থ কবি-উক্তিতে লােকোত্তররূপে পরিগণিত নিম্নোক্ত দৃষ্টান্তে ।

(ক) আমাকে শােনাতে হবে সেই কবেকার এক   সত্যমাথুর ।

      প্রবাহ নদীর প্রাণ, – নাবিকের দল ফিরে এসাে,

      আমার দু’পাশে আজ মরা ঢেউ, অভিভূত অন্য বন্দর!

(খ) এ বৃষ্টি কি নবজন্ম?

      কিছুই জানিনা শুধু অকৃসিজেনের নল নাকে নিয়ে বসে থাকি জাগাতুর।

     আর শব্দে টের পাই : একলক্ষ জিরাফ, হলুদ সাপ, সিংহের সবুজ দল

      সমস্ত জীবন ভেঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে আমার ভিতরে

(গ) দেরী হয়ে গেছে বৃক্ষ। পায়ে ধর বলাে

      আমার ক্ষয়িষ্ণু জমি, কোন মহাদেশে গেলে

      ফিরে পাবে সুরেলা সবুজ

উপর্যুক্ত দৃষ্টান্তে পুনরুজ্জীবন ঘােষিত হয় কোন মূল্যবােধে? সত্যমাথুর আবুল হাসান পাপ ও পবিত্রতাকে জৈবিক সত্যসন্ধে প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে পুরা-ইতিহাস-পুরাণ মিথস্ক্রিয়ায় সামগ্রিক বিষয়কে রূপময় সৌন্দর্যে ভূষিত করেন। সেখানে সৌন্দর্য কামগন্ধভারাতুর, ললিতলােভনকান্তি।

সৃষ্টি এত সৌন্দর্যপ্রধান! সৌন্দর্য এমন ভীরু এমন কুৎসিত!

সাপ, খেলনা, নর্তকী, নদী ও নারী

অপাপবিদ্ধতায় স্বর্গ-নরকের পৌরাণিক বিশ্বাস কিংবা সমাজসাপেক্ষ বেশ্যালয়, ঘােলামদ, অশ্লীলতা ক্ষ্যাপা দূর্বাশার ক্ষেদে পুড়িয়ে ফেলেন। নৈর্ব্যক্তিক চিন্তনে জগতের বৈভবকে এক ধরণের পার্থিবতা দেন, তার ভেতরেই তুমুল হয়ে ওঠে অপার্থিব আকুলতা। যেটি সময় ও সমাজ-নিরপেক্ষ হয়েই চিরন্তনতা লাভ করে। মরমী বা আধ্যাত্মিক অবিনাশী রূপে যাবতীয় কুৎসিত-কণ্টককে হরণ করে। রচনা করে সেই মর্মজ্ঞান যা একমাত্র ও অনিঃশেষরূপে মানুষেই সর্বশেষরূপে পরিগণিত।

৪.

‘ললিতলােভনকান্তি’ কবি আবুল হাসান স্বল্পায়ু ছিলেন। উপর্যুক্ত কাব্যগ্রন্থ ছাড়া তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর প্রকাশিত হয় আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা (১৯৮৫)। অগ্রন্থিত কবিতার মধ্যে আবুল হাসানের শব্দানুসন্ধানী, ছন্দবৈচিত্র্যপিয়াসী কবিসত্তায় উন্মােচিত। তাতে দ্বন্দ্বময়, প্রতিবাদী কিংবা রমণীমােহন রূপ সার্বিক সমাজকন্দরে প্রকাশলাভ ঘটে। এতে কবির উল্লিখিত তিনটি কাব্যেরই ভাবনাজ্ঞাপক মিশ্রিত উপলব্ধি ব্যঞ্জিত হয়। অগ্রন্থিত কবিতাসমূহের ভেতরে পূর্ণ কবির মুখশ্রী নির্ণীত হতে পারে। এ অংশের মুদ্রিত কবিতাও বেশ সুখপাঠ্য। “লােকটা যখােন নিঃসঙ্গ” (শ্ৰাবণ ১৩৭৫, মােহাম্মদী), “কত বয়স হলাে তাদের” (জুন-আগস্ট ১৯৭০, কণ্ঠস্বর), “যাই” (ডিসেম্বর ১৯৭২, পূর্বদেশ) এমন প্রায় দেড়শর মতাে কবিতা নানা সময়ে (১৯৮৫ পর্যন্ত) বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে গ্রন্থিত “যুগলসন্ধি” (ডিসেম্বর ১৯৭৩, দৈনিক জনপদ) কবিতাটি প্রথম দুটি স্তবক উদ্ধৃত করে কবির কাব্যচূড়া সনাক্ত করা যেতে পারে :

দেখা হলাে যদি আমাদের দুর্দিনে

আমি চুম্বনে চাইবাে না অমরতা!

আমাদের প্রেম হােক বিষে জর্জর

সর্পচূড়ায় আমরা তাে বাঁধি বাসা।

থাকুক দু’চোখে দুর্ভিক্ষের দাহ,

ঝরুক আবার আন্ধার আঁধিব্যাধি

আমাদের প্রেম না পেলাে কবির ভাষা

কাব্যচুড়ায় আমরা তাে বাঁধি বাসা।

বিন্যস্ত স্তবকে নঞর্থকতা সদর্থে পৌছায়। যেখানে সর্পবিষেজর্জর (সর্প=কামরতের প্রতীক!) প্রেমের অনল উদযাপিত হওয়ার সুযােগ পায় কাব্যচূড়ায়। প্রেম ও কাব্য সৌন্দির্যের সদর্থকরূপে প্রকাশ পায় কিন্তু এটিও দুর্দিন-দুর্ভক্ষের মিথুনজ্বালাব্যতিত নয়। এখানে প্রেম “নিকষিত হেম”। এটিই আবুল হাসানের মর্মজ্ঞান। আর এভাবেই কাব্যপাঠে এক মহৎ কবিকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

মন্তব্য: