আসাদ চৌধুরীর কবিতার সহজপাঠ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

তপন বাগচী

আসাদ চৌধুরী অধ্যাপনা করেছেন, জার্মান বেতারে চাকরি করেছেন, বাংলা একাডেমী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এসকল বাহ্যিক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি কবি ও কথক। আসাদ চৌধুরীর সত্যফেরারী তাে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিংবা গরিবের দিন যায় কী করে? / জানিবার সাধ হলে হাত দাও শিকড়ে- এই জাতীয় কবিতা কেবল বইয়ের পৃষ্ঠায় আবদ্ধ থাকে না। বইয়ের পৃষ্ঠা ছেড়ে এগুলাে বইরে চলে আসে, মানুষের মুখে মুখে আবৃত্ত হয়। একটি কবিতা অনেকেরে কবিতা হয়ে ওঠে। আর তখনই বােধহয় কবির লেখনী সফল হতে পারে। আসাদ চৌধুরীর ফাগুন এলেই কবিতাটিও একই গােত্রের-

ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে

থেকে থেকেই ডাকে

তাকে তােমরা কোকিল বলবে? বলাে।

আমি যে তার নাম দিয়েছি আশা

নাম দিয়েছি ভাষা,

কতাে নামেই ‘তাকে’ ডাকি

মেটে না পিপাসা।

ফাল্গুন নিয়ে বাংলা ভাষায় অজস্র কবিতা লেখা হয়েছে। তবু আসাদ চৌধুরীর কবিতাটি একটু ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়। তিনি ফাগুনের-একুশের চেতনাকে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন ওই কবিতায়। শহীদদের প্রতি কবিতায় এই সম্পূরক প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্নের মাধ্যমে কবি পাঠককে জবাব খুঁজে দিয়েছেন। কবিতাটি এমন-

তােমাদের যা বলার ছিল

বলছে কি তা বাংলাদেশ?

শেষ কথাটি সুখের ছিল ?

ঘৃণার ছিল ?

নাকি ক্রোধের,

প্রতিশােধের,

কোনটা ছিল ?

নাকি কোনাে সুখের

নাকি মনে তৃপ্তি ছিল

এই যাওয়াটাই সুখের।

তার সত্য ফেরারী কবিতায় আমরা দেখেছি সহজকথনের মাধ্যমে কী চমৎকার কঠিন কথা তিনি বলতে পেরেছেন। ভাষা পুরােপুরি আয়ত্তে না হলে এমন সহজভাবে কাবিতা লেখা যায় না। তাই তিনি একবার বলতে পেরেছিলেন-

কোথায় পালালাে সত্য?

দুধের বােতলে, ভাতের হাড়িতে। নেই তাে

রেষ্টুরেন্টে, হােটেলে, সেলুনে,

গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,

টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,

নৌকার খােলে, সাপের ঝাপিতে নেই তো।

সত্য খুঁজতে বেরিয়ে কবি দেখেছেন, সত্যকে পাওয়া খুব সহজ নয়। কারণ-

কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই

রমণীর চারু অঙ্গিতে নেই

পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই

নাটকের কোন সংলাপে নেই

শাসনেও নেই, ভাষণে নেই

আঁধারেও নেই, আলােতেও নেই

রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,

উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই

—–

এমন কি কালােবাজারেও নেই

কোথায় গেলেন সত্য?

এত সহজভাবে সত্যের সন্ধান ক’জন কবি করতে পেরেছেন, আমার জানা নেই। আসাদ চৌধুরীর বড়গুণ এই যে খুব সহজেই তিনি মনের কথাটি বলতে পারেন কবিতার গুণকে ক্ষুণ্ন না করেই। একেবারেই ছােট ছাোট বাক্যে, পরিচিত শব্দে, কখনাে রূপকথার রূপকে

তিনি বাংলাদেশের কথা তুলে ধরেন। একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জারিত তাঁর সকল কবিরা। এমনকি তিনি যখন বারবারা বিড়ালকে নিয়ে কবিতা লেখেন, ভিয়েতনামের শান্তি কামী মানুষের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেন, তখনও তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিকে রূপকের মােড়কে উপস্থাপন করেন।

বারবারা

ভিয়েতনামের উপর তােমার অনুভূতির তরজমা আমি পড়েছি-

তােমার হৃদয়ের সুবাতাস

আমার গিলে-করা পাঞ্জাবিকে মিছিলে নামিয়েছিল

প্রাচ্যের নির্যাতিত মানুষগুলাের জন্যে অসীম দরদ ছিল সে লেখায়

আমি তােমার ওই একটি লেখাই পড়েছি

আশীর্বাদ করেছিলাম, তােমার সােনার দোয়াত কলম হােক।

দেশলাইয়ের বাক্সর মতাে সহজে ভাঙে

গ্রন্থাগার, উপাসনালয়, ছাত্রাবাস,

মানুষের সাধ্যমত ঘরবাড়ি

সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ফুলকে সে বুট জুতােয় থেঁতলে দেয়।

এই যে সাতকোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ, তার প্রতিই কবির প্রেম সদাবহমান। তাই ভিয়েতনামের কথা বলতে গিয়েও তিনি স্বদেশকে বিচ্ছিন্ন হন না। মা-মাটি-মানুষই হচ্ছে কবি আসাদ চৌধুরীর মূল উপজীব্য।

তবক দেওয়া পান (১৯৭৫), বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়(১৯৭৬), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), টান ভালােবাসার কবিতা (১৯৯৭), ‘বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃষ্টির সংসারে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সােজা নয় (২০০৬) প্রভৃতি নাই কি প্রমাণ করে না যে আসাদ চৌধুরী তাঁর সময়ের কবিদের থেকে আলাদা হতে পেরেছেন? কেবল কবিতা নয় অলকার ফুল (১৯৮২) প্রবন্ধগ্রন্থ তাঁর গদ্যসত্তার প্রমাণ দেয়। বিশ্বসাহিত্যের রূপান্তর কিংবা পুরাণকথার পুনর্লিখনেও তাঁর সিদ্ধি প্রমাণিত। বিশেষত রাজার নতুন জামা (১৯৭৯), রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০), গ্রাম বাংলার গল্প (১৯৮০), ছােট রাজপুত্র (অনুবাদ: ১৯৮২), গর্ব আমার অনেক কিছুর (১৯৯৬), ‘ভিন দেশের মজার লােককাহিনি (১৯৯৯), তিন রসরাজের আড্ডা (১৯৯৯), কেশবতী রাজকন্যা (২০০০), গ্রাম বাংলা আরাে গল্প (২০০০), তােমাদের প্রিয় চার শিল্পী (জীবনী, ২০০০), জন হেনরি (আমেরিকার লােককাহিনি’, ২০০১), ছােটদের মজার গল্প (২০০১), সােনার খড়ম (২০০৬), মুচি-ভূতের গল্প (২০০৬) প্রভৃতি গ্রন্থ বাংলা শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর লেখা জীবনীগ্রন্থ সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩), রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯), স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী (২০০১) মিকালেঞ্জেলা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৩) নামের কিশােরপাঠ্য বইটি মুক্তিযুদ্ধ-সম্পর্কিত সেরাগুলাের একটি। এছাড়া উর্দু ও প্যালেস্টাইনি ভাষার কবিতা অনুবাদ করেছেন। এ সকল কাজের নজির আসাদ চৌধুরীর বহুমুখিনতার প্রমাণ দেয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও আসাদ চৌধুরী কেবলই কবি হিসেবে দেশব্যাপী নন্দিত। কবিতাচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৭), ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার, অশ্বিনীকুমার পদক (২০০১), জীবনানন্দ দাশ পদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬)। একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক ও আলাওল পুরস্কার ছাড়া দেশের প্রায় সকল পুরস্কারই পেয়েছেন কবি আসাদ চৌধুরী। পুস্কারপ্রাপ্ত অনেক কবির চেয়েই আসাদ চৌধুরী দেশব্যাপী পঠিত, নন্দিত ও স্বীকৃত। কেবল কবিতা আর কথকতা দিয়েই তিনি জয় করেছেন মানুষের মন।

মন্তব্য: