জলসিঁড়ি : এক সাহিত্যসিঁড়ির নাম

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আনিফ রুবেদ

আকাশ শুধু ধরা নয়, আকাশ নানা রঙে রাঙিয়ে চিত্রময়, মধুময় করে তোলার বাসনা থেকে শিল্পী/লেখক তার রক্ত নিয়ে, শ্বাস নিয়ে, হৃদয় নিয়ে বসেন। প্রত্যেক শিল্পী/লেখকের শুরুর ব্যাপারটা প্রায় এমনই থাকে।

লেখাটা লেখক দিয়েই শুরু করা গেল। লিখছি একটা পত্রিকা নিয়ে। পত্রিকা লেখককৃত বর্ণিল আকাশ দেখার এবং দেখানোর ব্যাপারে ব্যাপারির ভূমিকা পালন করে। সুতরাং দুটোই একসাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ক্ষেত্রে।

ইন্টারনেট সংস্কৃতি বেড়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার এতেও সন্দেহ নেই যে, এটা আরও বাড়বে। তবে এখনই ‘এ জাতীয় প্রকাশনা ক্রমশ অনুবীক্ষণীয়’ হয়ে যায়নি। প্রচুর কাগজ বেরুচ্ছে বিভিন্ন স্থান থেকে। তবে মানের ব্যাপারে হয়ত কথা বলা যেতে পারে। সম্পাদকীয়র একটা কথা খুব মনে ধরেছে ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চাকে উপাসনার পর্যায়ে রাখতে চায়’। প্রতিজ্ঞা অটুট থাক।

জলসিঁড়ির জলে ভিজলাম কদিন। বেশ একটা মিশ্র মি¯্রি আবেশে কাটল সময়টা। এ কেটে যাওয়া সময়টা নিয়ে লিখতে বসলেই মনের ভেতর বিরাট সব বিভ্রাট তৈরি হয়। কি লেখা যেতে পারে মনে আসে না। প্রকৃত সমালোচক না হলে যা হয়।

একজন লেখকের দেহ সসীম কিন্তু তার মন আর মনোবৃত্তি অসীম। অনুরূপ একটা ছোটকাগজ নামের আগে ‘ছোট’ কথা লাগিয়ে রাখে কিন্তু তার ভেতরের বাসনাটা বিশাল শালবৃক্ষের মত, শালবনের মত।

একটা ছোটকাগজ বিরাট একটা ভাবকে ধরে এগুবে এমনটাই আশা করি। সে ভাব হবে নির্দিষ্ট। ব্যাপারটা অনেকটা এমন – আমি এটা করব আর এটা করব না। ছোট কাগজ হবে সিরিয়াস, এমনকি সিরিয়াস নয় এমন বিষয়েও।

ঝড় আর বাতাসের মধ্যে একটা মৌলিক ফারাক আছে। দুটোরই দরকার আছে কিন্তু বাতাসটা বেশি প্রয়োজন। শান্ত বায়ুর আয়ুর বৃত্তটা বড় হয়। ঝড় আসে উড়িয়ে নিয়ে যায় যা পায় সামনে। জলসিঁড়ির ভেতর বাতাসস্বভাব নেই বলব না কিন্তু ঝড়ের স্বভাবটায় বেশি যেন। সেটা কমিয়ে স্বাভাবিক একটা গতি গ্রহণ করলে আরও ভালো হবে বলে মনে করি। শান্ত বাতাস মানুষের প্রতিদিনের ফুসফুসকে শ্বাস যোগান দেয়।

যা হোক। অনেকগুলো লেখককে একসাথে পাবার আনন্দই আলাদা। একে একে ভাঁজ খুললাম, আনন্দ দেখলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আনন্দে মুহ্যমান হলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অকিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেগুলোর বিবরণ, আবরণ নিচে থাকল।

বাংলা গদ্যের চমৎকার এক গদ্যকার শহীদুল জহির। যাঁর লেখা অল্প কিন্তু এই অল্প দিয়েই তিনি বিশাল রমণীয় গদ্যবাগান তৈরি করে গেছেন। তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন মোজাফ্ফর হোসেন। গদ্যটি ভালো লেগেছে। বিশেষ করে তার বিশ্লেষণগুলো অনুপম মনে হয়েছে।

অনিল দে-মনি এর রচনা সুন্দর, যেসব তথ্য তিনি দিয়েছেন তা আরও বেশি মূল্যবান। এ সকল তথ্য এ প্রজন্মের কাছে আনন্দদায়কও হবে। আমার ধারণা এ বিষয়টা অনেকেই জানেন না।

‘কবিতাপর্ব – এক: চৌদ্দজন কবির চৌদ্দ স্বাদের কবিতা আছে। চৌদ্দ স্বাদই যে পছন্দ মোতাবেক মতের ভেতর, মতির ভেতর ঢুকেছে এমন নয়। কিছু কবিতাতো আছেই যে কবিতাগুলো সেসব কবিদের কলম/কিবোর্ড থেকে আশা করা যায় না। তারা আরও অনেক ভালো কবিতা লেখেন। জলসিঁড়িকে আরও একটু নির্মোহ হতে হবে। নামের বিবেচনা বাদ দিতে হবে।

কবিতাপর্ব- দুই: এখানে আমার লেখাও আছে। আবার দশকটাও আমার। সুতরাং এ পর্ব নিয়ে কোনো কথা বলতে বাধছে একটু। ফিরোজ আহমদ সকলের কবিতা নিয়েই বলেছেন বেশ। গদ্য বেশ সুগঠিত।

কবিতাপর্ব- তিন: দ্বিতীয় দশকের ১৫ জন কবির কবিতা এখানে আছে। ‘মেঠো ও ময়দান’ আলোচনাতে সব্যসাচী হাজরা ও প্রদীপ চক্রবর্তী কবিতাগুলোর স্বরূপ এবং প্রবনতা নিয়ে কথা বলেছেন। তারা অনেকটা সফলও হয়েছেন বলে মনে হয়েছে আমার। অনেক নতুন আর নাম না চেনা কবির কবিতা এখানে ঠাঁই পেয়েছে। এটা একটা আশার কথা। এখানে জলসিঁড়ি ধন্যবাদ পাবার যোগ্য।

শিকদার ওয়ালিউজ্জামান এবং তুষার প্রসূনের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে দুটি আলোচনা পত্রস্থ হয়েছে। দুজনেরই প্রচুর কবিতা পড়েছি আমি। বইয়ের আলোচনা নিয়ে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু এটুকু বলতেই হচ্ছে, আলোচনাটি আরো গভীর হবার প্রয়োজন ছিল। ভাসা ভাসা ভাষায় ভেসেছে শুধু, ডোবাতে পারেনি যেন। তবে গালিব রহমান’র আলোচনাটি বেশ সুখপ্রদ হয়েছে। সবচে ভালো গদ্য যেন এটি।

কাগজটিতে তিনটি গল্প প্রকাশ হয়েছে। তিন গল্পের ভেতর এম মনির উজ-জামান এর গল্পটি দারুণভাবে ভেতর বাহির ছুঁয়ে গেছে। হাসির ভেতর দিয়েই গভীর এক বোধের কথা বলেছেন তিনি। শক্তি ক্ষমতার রূপ, স্থিতি এবং তার পরিবর্তন নাড়া দিয়েছে ভেতরকে।

শিকদার ওয়ালিউজ্জামান যেখানে হাত দেন সেখানটাই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ‘মাগুরা জেলার লোক বিশ্বাস ও সংস্কার’ তেমনই একটা লেখা। খুব চমৎকার ছন্দের ভেতর দিয়ে বলে গেছেন তিনি। এটার জন্য তিনি আলাদা রকমের, আলাদা সুগন্ধের শুভেচ্ছা পেতে পারেন।

দেবাশীষ মন্ডল সকলের পরিচিত না হলেও যারা সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন তারা সকলেই জানেন তার কবিতা কত ধারাল আর হৃদষ্পর্শি। তিনি অকালে চলে গেছেন। রইস মুকুল তাকে নিয়ে যে স্মৃতিচারণামূলক লেখাটি লিখেছেন সেটি আমাদেরও মন ছুঁয়ে গেছে। দেবাশীষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

সপ্তকের সাহিত্য উপাসনার ফল জলসিঁড়ি। এ ফলের নির্যাস আমরা পেতেই থাকব এমন আশাবীজ হৃদয়ে পুঁতে রাখলাম।

মন্তব্য: