‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ : একটি কবিতা, একটি কাব্য

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মামুন মুস্তাফা 

বাংলাদেশের কবিতায় যেকজন কবি অল্প সংখ্যক কবিতা লিখে নিজেদের একটি স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদের অন্যতম বর্তমান প্রবাসী কবি শহীদ কাদরী। পঞ্চাশের প্রধান তিন কবির একজন হিশেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন কবি শহীদ কাদরী। উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (১৯৭৪) এবং কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮) মাত্র তিনটি কাব্য লিখে পাঠকের মনন ও বোধে সাড়া জাগাতে পারেন, এমন কবি বাংলাদেশের কবিতাঙ্গনে হাতেগোনা কয়েকজনই রয়েছেন। আধুনিক কবিতার নাগরিকতা ও নৈঃসঙ্গ্যবোধ যেমন রয়েছে তাঁর কবিতায়, তেমনি জীবনতৃষ্ণার বিপুলতা বিষয়বৈভবের বিচিত্রতায় তাঁর কবিতায় স্থান করে নিয়েছে। 

নগর যন্ত্রণার ঘাতপ্রতিঘাত, হতাশা, নৈরাশ্য, সমকালীন জীবনের বিকার, বিদ্বেষ, ঘৃণা, শঠতা, হৃদয়হীনতা এবং নৈঃসঙ্গ্যবোধের তাড়না থেকে শহীদ কাদরীর কবিতা ভিন্ন মাত্রার দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। যেখানে জীবনবোধের সাথে মননেরও ছাপ স্পষ্ট। আর তাই স্বল্পসংখ্যক কবিতা লিখেও কবি হিশেবে শহীদ কাদরী তাঁর পাঠকের হৃদয় ও মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন সহসাই। উপরোক্ত সকল বিষয়ই শহীদ কাদরীর উল্লিখিত তিনটি কাব্যের প্রধান সুর হলেও তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কবিতাগ্রন্থে মূলত প্রেম ও অপ্রেমের ইতিবাচকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র অভ্যন্তরে সংঘটিত মূল্যবোধের অবক্ষয়। 

মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ বাস্তবতায় তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কবিতাগ্রন্থে দীপ্র উচ্চারণ লক্ষণীয়। এর কবিতাগুলোতে উপমা শ্লেষ কিংবা উত্তুঙ্গ শব্দের ব্যবহার কবিতাকে অন্য-মাধুরীর শিল্পিত নান্দনিকতায় পৌঁছে দেয় পাঠককে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কবিতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। গ্রেনেড, মেশিনগান, বেয়োনেট, বুলেট, রাইফেল প্রভৃতি যুদ্ধগন্ধী শব্দের সাথে জীবনঘনিষ্ঠ নান্দনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন শহীদ কাদরী তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে। ফলশ্রুতিতে রাষ্ট্রের অত্যাচার, পীড়ন-ব্যর্থতা, সামরিক শাসন ইত্যাদির জঙ্গমতা লক্ষ করা যায়। যুদ্ধোত্তর মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ, রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতা, উন্মূল উদ্বাস্তু মানুষের আত্মকথন বিৃবত হয়েছে তোমাকে অভিবাদন, হে প্রিয়তমা কাব্যের পরতে পরতে। আবার এতসব নৈরাশ্যের  ভেতরেও কবি ঝাঁঝালো বারুদের গন্ধে ইতিবাচক নিরাময়ের উচ্চতর শ্লোগান অঙ্কিত করেন। এ দুয়ের সম্পূরক যোগসূত্র হিশেবে দু’একটি উদাহরণ টানা যাক:

ক. আমাদের চৈতন্যপ্রবাহে তুমি ট্র্যাফিক আইল্যা-/হে রবীন্দ্রনাথ কিংবা তুমি সে রাতের পার্কে আমার আলো-জ্বলা/অন্তিম রেস্তোরাঁ! (রবীন্দ্রনাথ : তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা)

খ. হে আমার শব্দমালা, তুমি কি এখনও বৃষ্টি-ভেজা/বিব্রত কাকের মতো/আমার ক্ষমাহীন ডাইরির পাতার ভেতর বসে নিঃশব্দে ঝিমুবে, …যদি পারো গর্জে ওঠো ফিল্ডগানের মতো অন্তত একবার… (কবিতা, অক্ষম অস্ত্র আমার : তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা)

গ. ব্ল্যাক আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে/বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি:/আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হয়ে/নিজেদের ঘরে। (ব্ল্যাক আউটের পূর্ণিমায় : তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা)

এভাবেই কবি শহীদ কাদরী সকল পশ্চাৎপদতা, নীচতা, ভমি, রাষ্ট্রের সকল সুবিধা ভোগকারী একদল মুনাফাখোর-লোভী স্বার্থান্বেষী মানুষের কাছ থেকে বিকলাঙ্গ স্বদেশভূমিকে রক্ষা করতে এবং তার মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্নবীজ বপন করেন। আর তাই সকল প্রকার রুগ্ন-অসুস্থতার ভেতরে রবীন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয় খোঁজেন। কবিতার অক্ষম শব্দমালাকে বিপ্লবী হতে বলেন। আবার কখনো সকল বিধিনিষেধের বেড়াজাল ডিঙিয়ে বিদ্রোহী পূর্ণিমায় সতত নিজের পূণ্যভূমিতে ফেরার স্বপ্ন দেখেন। শহীদ কাদরী মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় যে অবদমন, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অনিবার্য পতন লক্ষ করেন, সেগুলোকেই  তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কবিতাগ্রন্থের সকল কবিতায় প্রতিফলিত হতে দেখি। তবে বলা আবশ্যক সকল কবিতার সারবত্তা ধ্বনিত হয়েছে এ কাব্যের প্রধান কবিতা তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’য়। কাব্যের সকল কবিতায় বিবৃত অথচ খ-িত স্বপ্ন বাস্তবায়নে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কবিতার ভেতরে একটি সুস্থ, সবল, নান্দনিক, গণতান্ত্রিক, সন্ত্রাসমুক্ত চোরাচালানহীন ও খুনহীন রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণের কথা বলেছেন কবি: 

ভয় নেই

আমি এমন ব্যবস্থা করব মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে

শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন

আমি এমন ব্যবস্থা করব গণরোষের বদলে

গণচুম্বনের ভয়ে হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

(তোমাকে অভিবাদন, হে প্রিয়তমা : তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা)

শহীদ কাদরী অভিজ্ঞতার যে ভুবনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার পেছনে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবনের নির্দয় অভিঘাত পরোক্ষ পরিচয়ে তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। কবিতায় আপন এইসব অভিজ্ঞতার বিভিন্ন ইঙ্গিত মেলে ধরেছেন শহীদ কাদরী। বিচ্ছিন্নতা, স্বাধীনতা, স্বজনহনন, রাষ্ট্র অভ্যন্তরে ব্যক্তি ও সমাজব্যবস্থার আকস্মিক সমূহপতন, মূল্যবোধের বিপর্যয় ইত্যাদির ভেতর দিয়ে দেশভাগ ও উন্মূল জীবনের অভিঘাত আমরা দেখি শহীদ কাদরীর তিনটি কাব্যের বিভিন্ন কবিতায়। সুতরাং শহীদ কাদরী কালের কথক হয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতার বহুমাত্রিকতা এবং উপলব্ধির বিস্তার দ্বারা। আর তাকে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কাব্যে পরিমিত কাব্যভাষায় প্রকাশ করেছেন। 

শহীদ কাদরীর ব্যক্তিগত জীবন ও পরিবেশ তাঁর কবিতাকে প্রভাবিত করেছে। জীবনের শূন্যতা ও নিষ্ঠুর নিয়তির অভিসন্ধিও তাঁর কবিতায় ঘুরপাক খায়। ফলে তাঁর কবিতায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, সামগ্রিক সচেতনতাবোধ ও সামাজিক দায়িত্ববোধ অনুপস্থিত বলা যাবে না। আর তাই সময়, সমাজ ও জনমানুষের ভেতরের অস্থিরতা, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ও বিষণœতা, এমনকি প্রেম সম্পর্কেও অতৃপ্তি বিবৃত হয়েছে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কবিতাগ্রন্থে।  

মূলত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পরবর্তী কালে রচিত একধরনের ইতিবাচকতা ও সপ্রাণ মুখরতা যুক্ত হয়েছে তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা কাব্যের বিভিন্ন কবিতায়। সমাজভাবনা, রাষ্ট্রচিন্তা এবং প্রেম বিবিধ বিষয়ে বোদলেয়ারের বিষণ্ন মেঘের অপসৃত প্রপঞ্চ লক্ষ করা যায়। ভায়োলেন্ট উপমা ও শব্দাবলীর তুমুল ব্যবহার এ কাব্যে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের কবিতায় একধরনের আক্রমণাত্মক কাব্যভাষা স্বাধীনতা-উত্তরকালে গড়ে ওঠে, যার ভেতরে যুদ্ধের বিবিধ ক্ষতচিহ্ন, প্রকাশভঙ্গিতে তীব্র অসহিষ্ণুতা ও ক্ষোভ দেদীপ্যমান। এই কাব্যে স্বকীয় যুদ্ধাভিজ্ঞতার সাথে শহীদ কাদরী যুক্ত করেছেন ইঙ্গ-মার্কিন কবিদের কবিতার দৃপ্ত আক্রমণাত্মক ভাষাভঙ্গি।

মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ দিয়েই কবি শহীদ কাদরী বাংলাদেশের কবিতায় নিজের একটি স্থায়ী আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। পঞ্চাশ উত্তর বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিক মনন ও জীবনবোধ সৃষ্টিতে যে ক’জন কবির নাম করা যায় তাঁদের মধ্যে কবি শহীদ কাদরী অন্যতম। একুশ শতকের প্রজন্ম তাঁকে মূল্যায়ন করবে বাংলা কাব্যের নিরিখেই, যেখানে শহীদ কাদরী এক স্বতন্ত্র কণ্ঠ নিয়ে স্বাধীন স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল।

মন্তব্য: