নির্ঝর নৈঃশব্দ্য’র কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সদ্য সমুজ্জ্বল

কবিতায় গল্প কিংবা কবিতার গল্প- দুয়ের জন্য প্রস্তুতি দরকার। প্রথম প্রস্তুতি কবির এবং দ্বিতীয় প্রস্তুতি পাঠকের। পাঠকের প্রস্তুতি কোনো অংশে কবির প্রস্তুতি থেকে কম হলে কবিতা পরবর্তী পাঠকের প্রত্যাশায় থাকে। কবির চিন্তার মাত্রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পরিমাপ করা সম্ভব হয় না পাঠকের পক্ষে। কোনো উন্নত পাঠক পাওয়া কবির জন্য সত্যিকার অর্থে সৌভাগ্যের। সে অর্থে আমি উন্নত পাঠক নই। বলা যায়, প্রস্তুতির পর্যায়ে আছি। কবিতার বোধ উপলব্ধির বিষয়। সচেতন পাঠকমাত্রেই তা জানেন। কিন্তু কবিতার আলোচনা কিংবা পাঠ প্রতিক্রিয়া নিতান্তই যন্ত্রণার। কারণ কিছু বিমূর্ত উপলব্ধি থাকে, যা প্রকাশ করতে গেলেই ছন্নছাড়া হয়ে যায়। তাই আমার মনে হয় কবিতার বোধ যতক্ষণ পাঠকের হৃদয়ে থাকে তা অনুভবের; প্রকাশ করতে গেলেই অনুভব-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-এর কবিতা পাঠে গল্প পাওয়া যায়- অনুভবের গল্প, নস্টালজিয়ার গল্প, আক্ষেপের গল্প। গল্পের কেন্দ্রে মূলত কবি নিজেই থাকে। কবিকে কেন্দ্র করে পারিপার্শ্বিক অনুষঙ্গ আবর্তিত হয়। তাই কবির আমিত্বকে হতে হয় সার্বজনীন। নির্ঝর নৈঃশব্দ্য-এর কবিতায় যে ‘আমি’র সন্ধান আমরা পাই তা সার্বজনীন হলেও ব্যঞ্জনাহীন। তার কবিতার বোধ গগণচুম্বি। কিন্তু ভাষায় নেই কোনো পেলবতা। আটপৌরে শব্দেও ঝঙ্কার তোলা সম্ভব। তবে ‘চাঁদ ও চন্দ্রমল্লিকা’, ‘ভিড়ের মধ্যে’, ‘নদীর চর’ ও ‘জন্মান্তর’ কবিতা পাঠে মুগ্ধ! 

স্মৃতি ভোলার চেষ্টাই মানুষকে বেশিমাত্রায় আক্রান্ত করে নস্টালজিয়ায়। ভুলতে গিয়ে আরো বেশি জড়িয়ে যায়। কিন্তু কবিও স্মৃতি ভোলার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা করেছেন, তবে জীবন থেকে পালাতে চাননি। কুসুমের প্রতি তীব্র আর্তনাদ প্রকাশ করে ‘চাঁদ ও চন্দ্রমল্লিকা’ কবিতায় কবি বলেন- ‘তুমি আসো না কেনো? হাতে রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক যন্ত্রণার।/কেনো পৃথিবীতে এখনো তোমার জন্ম হয় না, কুসুম?’ কবির এ আকাক্সক্ষা পৌঁছে যায় মহাকালের দ্বারে। কারণ যুগে যুগে কবিদের এ পবিত্র চাওয়া তো কাক্সিক্ষত নারীর দিকেই ধাবিত। তবে কবিদের ক্ষেত্রে প্রেমে পরিণয় অনিবার্য নয়। প্রেমের পরিণয়ে হতাশাই বাড়ে।

‘নদীর চর’ কবিতাতেও কবি কুসুমে প্লাবিত। কবির চেতনায় ‘কুসুম’ একটি যাতনার নাম। তাই মুহূর্তে কবি কুসুমে মগ্ন হন। জীবনের যা কিছু অগোছালো সব প্রার্থনা করেন মানসপ্রতিমা কুসুমের কাছে। অকপট চিত্তে বলেন, ‘নদীর চরটা গুছিয়ে দাও। শীতের ভোরে বিলম্বিত স্রোত থেকে মুছে/দাও অগভীর স্নান।’ ‘কুসুম আসো, গুছিয়ে দাও আমার হাতের পায়ের কুড়িটি আঙুলজুড়ে/ফুটে থাকা স›ধ্যার গান।’

যাদের শৈশব কেটেছে শষ্যের খেত, লতা-পাতা, ফুল-ফল, অরণ্য-বেষ্টিত প্রকৃতির মাঝে ইট-কাঠ-পাথরের সভ্যতায় হাঁপিয়ে উঠবেন এটাই স্বাভাবিক। যে মায়ের জীবন কেটেছে সবুজে ঘেরা প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে তার নাগরিক জীবন বড়ই কষ্টের। তাই আধুনিক মা শিশুকে প্রকৃতির নির্যাস দিতেই পিঠে এঁকে রাখেন ট্যাটু- প্রজাপতির। বন্দি শিশু তাতেই আপ্লুত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মায়ের কোলে। ‘প্রজাপতির ডানার ঘ্রাণে ঘিরে আসে ঘুম। শিশুটির মা একটি মেয়ে,/পরনের শাড়ি লাল। মেয়েটির পিঠে একটি উল্কি, প্রজাপতির। উল্কির/ছয় ইঞ্চি উপরে একটি শিশুর মুখ ঘুমিয়ে পড়েছে।’

কবির সংস্কারমুক্ত মনও কখনো কখনো সংস্কার আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। ‘জন্মান্তর’ কবিতায় সে সুরই ধ্বনিত হয়। কারণ কবি যেকোনো মূল্যে ‘শ্রীমতি’কে পেতে চান। কবি বলেন, ‘জন্মান্তর মানি না, শ্রীমতী। তবু পৃথিবীকে বানাচ্ছি ক্রমে তামাকের বন।/এই বনে পরের জন্মে তামাকের পাতা হবো, আর ধোঁয়া হয়ে/তোমার নিশ্বাসের ভিতর ঢুকে যাবো।’

কয়েকটি কবিতা পড়ে কবিকে বিচার করা ধৃষ্টতা। কবিতার বাক্যে আকাক্সক্ষা, আসক্তি থাকে; ক্ষেত্রবিশেষে যোগ্যতা নাও থাকতে পারে। কিন্তু আকাক্সক্ষা ও আসক্তির ব্যাপারে কবিকে সুচারু হওয়া জরুরি। কবিতার ইমেজ শব্দ ও চিত্রকল্প নির্ভর। কল্পনার গভীরতা সুদৃঢ় শব্দের মাধ্যমে ইমেজ তৈরিতে সহায়তা করে। সে দিকেও কবির সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করি।

মন্তব্য: