প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস: পাঠোত্তর উপলব্ধি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মােহাম্মদ নূরুল হক

কবিতার সঙ্গে গেরস্থালী যিনি করেন, তিনি জানেন কী করে যাপিত জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়কে কবিতায় অনুবাদ করতে হয়। এও জানেন কী করে নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়ম প্রবর্তন করতে হয়। প্রথাসম্মত পথকে অবলম্বন করেও প্রথাভাঙতে যিনি জানেন, তিনিই কবি। বীরেন মুখার্জীও সে ঘরানার।

তার সম্প্রতি প্রকাশিত কাব্যের নাম ‘প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস‘। এই বইয়ে স্থান পেয়েছে মােট ৫৪টি কবিতা। নিরূপিত-অনিরূপিত উভয় ছন্দেই লিখেছেন। অধিকাংশ কবিতা অনিরূপিত ছন্দে রচিত। বিষয় বৈচিত্র্য লক্ষণীয় একটি কবিতার বিষয়ের সঙ্গে অন্য কবিতার বিষয়ের স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। এক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর চেয়ে বিষয়ের প্রতিই যেন তার পক্ষপাত। কবিতার গৃহে যার নিত্য বসবাস, তাকে ‘হনন করেছে শব্দহীন ঝড়, কুয়াশার ফণা!’ অনেকটাই পরাবাস্তববাদী চেতনায় উন্মুখর আমাকে হনন করেছে শব্দহীন ঝড় কবিতার প্রতিটি পঙক্তি। এ কবিতায় কবিজীবন ও লৌকিক জীবনের মধ্যকার মৃদুস্ববিরােধ স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত কবি সঙ্গীহীন; তাই সহজস্বীকারুক্তি ‘বৃষ্টির ফোটায় পেতে রাখি সহজলভ্য সুখ।

গােপন-ভাষ্য, কবিতায় ‘প্রণয়ের চিহ্ন দেখে দেখে থেমে যায় পথ- বাউলের রঙিন পা’ বলার পরও চরাচরের বিভিন্ন অভিজ্ঞতাকে চিত্রায়িত করেন। লুকোচরি কবিতায় বিস্ময়কর উপলব্ধি তার জলের পাতকী আমি জলহীন ঘুমে। ‘তুমি আর আমি’, ‘স্বেচ্ছা মৃত্যু’, ‘তােমার চুলের ক্লান্ত কাঁটায়’, কিংবা ‘তােমার চোখ ছুঁয়ে’, ‘নিষিদ্ধ গন্দম’, ‘আজ তবে এখানেই থাক’, ‘আমার জিজ্ঞাসাগুলাে’, ‘চাষবাস’, ‘অন্ধকার পােড়াতে এসে’, ‘নদীর কাছে এসে’, ‘নীল নির্জনতা’, ‘অন্ধকার ছায়ার কথকতা’, ‘নিষিদ্ধ জ্যোৎযার গান’, ‘সাধ ও সাধ্যের ঘ্রাণ’, ‘শূন্যতা বিষয়ক খসড়া’, ‘ঠিকানা’, ‘তৃষ্ণার্ত সময়ের পদাবলী, ‘তােমাকে জাগাতে চাই’, ‘বিল পারের মেয়ে’ প্রভৃতি কবিতায় কবির প্রতিবেশ যেমন অঙ্কিত, তেমনি মনােজগতের বিভিন্ন অন্ধিসন্ধিও চিত্রায়িত।

‘অবাধ্য জোছনায় ওড়ে তােমার মুখ’ কবিতায় কবির উপলব্ধি ঘােরাচ্ছন্ন ‘কবিরা কেবলি নিমগ্ন থাকে শব্দ বিহারে…‘। কবির শব্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া অন্যতর কোনও কাজ আপাতত নেই। যা আছে তা সংসারী মানুষের। কবি যখন সংসারী মানুষ, তখন সংসারের যাবতীয় ছলাকলা ও কর্মযজ্ঞে তারও অংশ গ্রহণ স্বীকৃত। আবার কবি যখন কবিতার সরােবরে সন্তরণশীল, তখন কেবল কবিতার শব্দই তার আরাধ্য। মালার্মের শব্দই ব্রহ্ম শর্তটির পূর্ণ সমর্থন মেলে। ‘নদীবর্ণা গ্রাম হাঁটে চোখের আলুপথে’ কবিতায় সময় শব্দটি প্রয়ােগগুণে বহুরৈখিক হয়ে ওঠে। সময়ের হাত ধরে সময় দৌড়াচ্ছে দ্যাখাে, সময়ের স্রোতে উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে জীবনানন্দীয় কাল চেতনার আবহ মনে করিয়ে দেয়। জাবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন, ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’, তেমনি বীরেন মুখার্জীর উচ্চারণও বিভাজনহীন সময়ের সাক্ষ্য বহণ করে। এভাবেই কবিতা থেকে কবিতা ঋণপরিগ্রহণেও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। ঋণগ্রহণের ক্ষমতা যার থাকে না, সে হয়ে ওঠে প্রভাবিত কবি। যে ঋণগ্রহিতা ঋণ প্রসঙ্গ চেপে যায়, তাকে চৌর্যবৃত্তির দায় থেকে রেহায় দেয়া যায় না। কবিতে কবিতে উপলব্ধির প্রশ্নে অনেক সময় অভিন্ন ফলও ফলে। জীবনানন্দ-বীরেনের সেরকম একটি অভিন্ন উপলব্ধিজাত ধারণা যদি ঘটে তাতে বাংলা কবিতার উৎকর্ষের পথে সুফল ছাড়া ভিন্ন কিছু ঘটবে না।

সমিল অক্ষরবৃত্তে লেখা ‘বৃষ্টিচেতনার রাত’। চার স্তবকের। প্রথম তিনস্তবক চারপঙক্তির। শেষ স্তবক দুইপঙক্তির। অন্ত্যমিল গতানুগতিকতায় পর্যবসিত হয়নি। অন্ত্যমিলের ক্ষেত্রে কবি আশ্চর্য স্বাক্ষর দেখিয়েছেন। তবে অক্ষরবৃত্তের গীতিধর্মীর কারণে অনেকটা পয়ারের মতােও শােনায়। আজকের কবিদের দেখা যায় হয়তাে ছন্দবিদ্বেষী হতে, নয় মাত্রাশুমারী। একদল যখন ছন্দউচ্ছেদের শ্লোগান দেয়, অন্যদল তখন মাত্রাশুমারী করে, মাত্রাপুরণের হিসাবকেই ছন্দসিদ্ধি বলে দাবী করে। দুই পক্ষের দাবিই ভয়ানক, হাস্যকর। ছন্দ কি চোখের দেখার বিষয়? না কি মাত্রা গুণে গুণে হিসাব করার বিষয়? ছন্দ কবিতার ভেতর রক্তকণিকার স্পন্দনের মতােই। সুতরাং গুণে গুণে হিসাব মেলালে ছন্দ ধরা পড়বে না। বিষয়টি বীরেন মুখার্জী জানেন বােধ হয়। তাই তার কবিতায় জোর করে অন্ত্যমিল দেওয়ার কসরৎ যেমন নেই, তেমনি ছন্দহীনতার অপবাদও তার বিরুদ্ধে দেওয়া যাবে না। অলঙ্কার প্রয়ােগেও নতুনত্ব চোখে পড়ে। তবে কাব্যের নামকরণে কিছু অসতর্কতা পরিলক্ষিত। দীর্ঘ ও জটিল নামকরণের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সহজ নামকরণই কবিতার বইয়ের জন্য মাঙ্গলিক বলে মনে করি। কাব্যটি রসপিপাসুদের মুগ্ধ করবে বলেই আমার প্রত্যয়।

মন্তব্য: