বাতাসের মতো অদৃশ্য ইশারা : রিঙকু অনিমিখের কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শিবলী মোকতাদির

বিপুলা এই পৃথিবীতে আমাদের আসা হয়তো একবারই। এখানে যা-কিছুই চলমান তার চূড়ান্ত নৈরাজ্যের স্বাদ নিতে, রকমারী রহস্যের বৃত্তকে ভাঙতে আমরা যতটা পারি তারও চাইতে অধিক কল্পনা করি। আমাদের সত্তার বা আত্মার দুঃখের, বেদনার ভাষাকে অনুভূতির অনন্য রঙে রাঙাতে মরিয়া হয়ে উঠি। ঘুম থেকে ঘুম, মাঝে বহমান এই যে জাগরণ সেখানে কত কত মুখ, কত কাহিনি, কত বিলাপ, কত আহাজারি, কত পাওয়া না-পাওয়া, দুঃখ-শোক, ক্লান্তি-জরা, ক্ষুধা-খরা-প্যানারোমার মতো ভেসে যাচ্ছে বেশ্যা, মাতাল, চোর, পকেটমার, খুনী, ভ-, জারজ, উন্মাদ, সুদখোর, অন্ধ, ভিখারি। ভিড়ের মধ্যে অই দূর অন্ধকারেও সামান্য আলো হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখছেন কেবল একজনই। তিনি কবি। খাঁটি কবি? আজকাল কবি বলতেই কপালে ভাঁজ পড়ে যায় অনেকের। সেখানে খাঁটি! সে তো দূর অন্ত অতীব ভয়ংকর।

তবে কবিতার নীতিবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গীকে যারা বড় করে দেখেন, করেন কবিতার ভাষা, উপমা-চিত্রকল্প, বিষয় ইত্যাদির মধ্যে প্রচলিত শ্লীলতার অনুসন্ধান তাদের উদ্দেশ্যে এই কবি তরুণ তুর্কী রিঙকু অনিমিখ তাদের থেকে ড্যাশ ড্যাশ দূরত্বে থেকে আপন সংস্কার বর্ণগন্ধে রক্ষণশীল ধনিকশ্রেণির শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লিখছেন তার নিজস্ব কাহিনিধর্মী সহজাত কবিতা।

দেখি যে ফলের প্রাবল্যে ঢেকে যাচ্ছে গাছের গরিমা।

বটফল ক্ষুদ্র ও লাল

এত ছোট্টএকটি ফল অথচ

পাখির বিষ্ঠার মতো তুচ্ছ ও অচ্ছুৎ বস্তু

যা চোখেই পড়ে না

তার ভেতর থেকে উদ্ভূত উদ্ভিন্নক্রমে

বৃহৎ ফলাফল।

সত্যিই বৃহৎ ফলাফল বটে। কবিতা হবে এমনই। সে হবে স্বাধীন ও স্বেচ্ছাচারী। হাল তার যতই হোক মাতাল খাঁটি গেরস্থ হলে চাষের ভূমিকা নিয়ে দানাবেধে উঠবে না কোন আন্দোলন। একমাত্র কবিই পারে, কবিতাই পারে তুচ্ছকে তুঙ্গে তুলে ধরতে। কবিতায় যদি ভর করে অহির আছর তবে তা তর তর করে এগিয়ে যাবে আগাপাশতলা এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে। রিঙকুর কবিতায়ও ঘটেছে তার প্রতিফলন। কত অবলীলায় বলা যায় পাখির বিষ্ঠার মতো তুচ্ছ ও অচ্ছুৎ বস্তুতে ভর করে বটফল ছড়িয়ে যায়, বীজের বিস্তারে দেশ কালের কেন্দ্র ভেঙে বটগাছ এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় বৃহৎ আর বন্য রূপে। আমরা জানি। কত চেনা আর চলমান তাত্ত্বিকতায় ভরা। মনে হবে আমি কেন লিখিনি আগে? আহা…

তোমাদের উপেক্ষা আর হিংস্র চোখের দিনে

আতকে উঠেছিলো আমার যত ভয়

কবিতা লিখতে কে যে কখন কোন পথে প্রবেশ করে, আঘাত হানে আমাদের বোধের মর্মমূলে; আমরা কী নিজেও বুঝি তার সবটুক? কোন ঘোরে, পদার্থের কোন আয়তনে বিরাজ করি তখন-যখন কবিতা লিখি আমরা। মহাবিজ্ঞানের যুগেও বলতে গেলে এ এক অমোঘ রহস্যই বটে। কবিতা লেখা অনেকটা খুন করার মতো। খুনির যেমন ট্রেনিং লাগে না, কম বেশি সকল কবিরই একই দশা। রিঙকুর বেলাতেও ঘটেছে এমন। হুট করেই তিনি লিখে ফেলেন এমন সব বাক্যের ঝলকানি। কোন আগাপাশতলা না ভেবেই। লেখার এই যে মুহূর্ত, এই যে প্রেরণা বা প্রশ্রয়; খুব অবাক লাগে-তিনি কী করে কোথা হতে পান? কে তাকে দায় আর দিব্য দিয়ে লিখিয়ে ছাড়েন। এ এক জটিল পাগলামিই বটে। যা তিনি ঘটান নিঃসঙ্কোচে তার কবিতার-তথা লেখার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। সমাজ-সংঘবদ্ধতার অটুট বাঁধন ছিঁড়ে মুহূর্তে তিনি নিয়ম আর রীতির বাহিরে এসে ঘটান তার চেতনার উন্মেষ। একেই কি বলে অহি-প্রাপ্ততা?

সহজে কি সহজ হতে পারো?

আমি যদি সহজ না হই আরো।

আমি যদি সহজ না হই আরো

তুমি কি আর হাত বাড়াতে পারো?-

অভিমানের দেয়াল তুলে দিয়ে

ঠোঁটের মায়া- স্পর্শ দু’একবারও।

আমি যদি সহজ না হই আরো

আমি যদি সহজ না হই আরো

যুদ্ধে তুমি ক্ষান্ত দিতে পার?

গ্রেনেড বোমের দম্ভ ঝেড়ে ফেলে

ভালোবাসার আলোক-উৎসারও-

কৃষ্ণ প্রেমের মানব অবতারে

চৈতন্যের যোগ্য সমঝদারও

বলতে গেলে যাপিত জীবনের শাশ্বতবাক্যগুলোই রিঙকু তার কবিতায় ধারাবাহিকতার দৃষ্টান্তে আনতে চেয়েছেন। কখনো কাহিনিকে উহ্যে রেখে ছন্দকে প্রমোট করে। কীসব ম্যাজিক আর মন্ত্রে ধ্বংসের মাঝেই ছড়িয়েছেন দীপ্তি। পঙ্ক্তিতে, অদ্ভুদ সব ফ্রেজ-এর তেজ এসে লাগে, ঝাপটা দেয় নিষ্ক্রিয় কোষে। নির্বাসিত শ্বেত-কণিকার কানে। কবিমাত্রই চায় কবিতায় নিজেকে অতিক্রম করতে। একই গৃহ, একই শিক্ষক, একই পাঠ বিরক্তির চরম নির্দেশক। রিঙকু এ-ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বারংবার চেঞ্জ এনেছেন তার কবিতার সিলেবাসে। ইতিহাস আসলে তাকেই গ্রহণ করে যিনি নিজেও উপলব্ধি করেন ইতিহাসের গ্রহনীয়তা। কবিতাজীবনে রিঙকুর উপলব্ধি, জীবনপ্রবাহ তাকে আত্মস্থ করা হয়তো শুরু মাত্র। বহু পথ পড়ে আছে উত্তরে দক্ষিণে। পড়ে আছে তাদের শাখা ও সমষ্টি অষ্টাদশী নারীর বেণির চিকন ফিতের মতো।

আমাদের ছোট নদীগুলো

বড় বড় ব্রিজের নীচে লুকিয়ে থাকে

এখানে ভালোবাসাই একমাত্র বসন্ত, যেখানে কোনও ফাল্গুন নেই, বরং

মাথার উপর করপোরেট চোখের মতো তপ্তসূর্য স্থির হয়ে থাকে, যেনবা

পাহাড়ে ঝুলন্ত নিঃসঙ্গ শেরপা, দড়ি ছেঁড়া ভয় যার সারাক্ষণ ঝুলিয়ে রাখে

একটি শব্দ ধর্ষিত হয়ে গেল মানুষ নয় তবু

মানুষ নয় তবু একটি শব্দধর্ষিত হয়ে গেল

শব্দ ধর্ষিত হয়ে গেল মানুষ নয় তবু মানুষ ধর্ষক

মানুষই সব, সব মানুষের জন্য- এই পৃথিবী, ব্রহ্মা-, এই নরক।

শব্দটি কানে বাজামাত্রই চোখে ভেসে ওঠে একটি কুৎসিত দৃশ্যকল্প-

ছেঁড়া-খোড়া সালোয়ার কিংবা সেমিজ,

কোথায়, কোনদিকে কতখানি দূরত্ব অতিক্রম করলে প্রকৃত কবিতার লবণ্য খুঁজে পাওয়া যায়-পাঠক হয়ে আমরা যতখানি বুঝি, রিঙকু অনিমিখও বুঝেছেন ততখানি। কবিতার পরতে-পরতে তার স্নিগ্ধ সমাধান। কখনো বা বৃত্ত থেকে ছুটে গিয়ে অনাবৃত্ত সেইসব বাক্যে ঝরান অগ্নি আর ক্রোধের ব্যাকরণ।

অদ্ভুত সব উপমার বারান্দা পেরিয়ে কবিতাকে তিনি করেছেন, সুঠাম নারীর নগ্ন কোমরের মতো তীক্ষè-তেমনি প্রশস্ত নিতম্বের মতো দায়িত্বশীল। কবিতার ব্যাখ্যায় তিনি কখনো সন্ধ্যার বিষণœ কবরের মতো নিশ্চুপ। কখনো শৈশব আর সমুদ্রের স্মৃতির চাদরে ঢেকে রাখা জোনাকীর আলোকরতন।

প্রকৃতিকে তিনে দিয়েছেন যতখানি স্বাধীনতার প্রশ্রয়, ঠিক ততটাই প্রতারণার কাঠগড়ায় ঝুলে রাখা এক আর্দ্র আসামির প্রহেলিকা। তার দেশ-যেখানে আবির্ভূত সম্রাট আর শয়তানের আনাগোনা। আর সেখানেই মানুষ হয়ে ওঠে কতটা ভীরু, কতটা নির্লজ্জ, কতটা মাতাল। তবুও চতুর এই কবি ভূগোল ভেদ করে ইতিহাসের অন্ধকারেই নতুন দিনের মাঝে স্থাপন করতে চেয়েছেন রাতের পূর্ণিমাকে।

অ্যামেচার চোখ শুধু জানে

নোনতা জলের থেকে

কিভাবে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয়;

সে কথা বলতে বারণ-

কেউ যদি ভুল করে বলে তার নাম

মুখে তাচ্ছিল্য, অন্তরে হাজার প্রণাম

মূলত, শূন্যে ঝুলে আছি-

শূন্যতার আবাসন প্রকল্পে

পোড়ামাটির বাক্সে ভরে বিক্রি হচ্ছে আকাশ;-

এইসব বিপণন ব্যবস্থায় ‘মাটি ও নোট’ দুটোতেই

মহান ব্যর্থ আমি ঝুলে আছি শূন্যে

কবিতায় রিঙকু ঘুরে-ফিরেই এনেছেন মায়া, অন্য অর্থে মতিভ্রম। অসংখ্য নির্ভেজাল সত্যের সাদামাটা কাহিনির পাশাপাশিই তিনি আঁকতে চেয়েছেন সম্মিলিত পরাবাস্তবের দমবন্ধ করা এক নৈশ কোলাহল। যা একমুঠো কার্পাস তুলোর পাখি হয়ে তৃণের শয্যায় অপেক্ষা করে থাকে, দূরের বন্দরে নিত্য বালিকার নৈশভোজের আমন্ত্রণে। তার উচিত ও ন্যায়ের কথাকলির মাঝে মুহুর্মুহু মিশে যায় অরণ্য-তারিত সেইসব জিরাফ। অ্যামেচার চোখে মিশে যায় ঋতুর নগ্নতা নিয়ে শতাব্দীর সমুদ্রের সুবাতাস। যেখানে আলুথালু চুলের বিন্যাসে ফের এসে দাঁড়ায় কুহকের ন্যায় প্রকৃতির রূপ ধরে প্রেয়সী। হয়তো  ক্ষণস্থায়ী, তবুও তা অনির্বচনীয় উত্তেজনার তুঙ্গে তুলে রাখে। কবিতাকে করে, লোভনীয় টকের রসায়নে রসসিক্ত। জল আসা জিভের জৈব হন্তারক।

পুরোনো আসবাব ব্যবহারযোগ্যতা হারালে

বাড়ির আঙিনায় অযতেœ ফেলে রাখি

আসবাবের সঙ্গে অনেক ব্যবহারের স্মৃতি

জড়িয়ে থাকে বলে, কিছুদিন

ঘনঘন ওদিকে চোখ চলে যায়

তারপর আর মনে থাকেনা, হয়তো

পচে মিশে যায় মাটিতে

শুধু আসবারের পাশের কবরখানা

সেভাবেই পড়ে থাকে।

রিঙকু অনিমিখকে বিস্তারিতভাবে পাঠ করতে পারলে ভালো হতো। সরবরাহকৃত কতিপয় কবিতা নিয়ে সিদ্ধান্তের শিওরে যাওয়া দুষ্কর। তবু মনে হলো তার লিখনিতে ঝরার সম্ভাবনা আছে বিরামহীন অবিশ্রান্ত শ্রাবণ। যেখানে শুধুই দৃশ্যের পর দৃশ্য গ্রন্থিত হয়ে আছে। আছে অভিজ্ঞতার বিবৃতি-সে এক ভয়ানক, মানুষ আর মানষীর, ফুল ও ফলের, মেঘ হতে বাষ্পে, নক্ষত্রের সাথে মিশে আছে মৃত্যুর করতালি।

সেখানে জন্ম-মৃত্যুর অবারিত আয়োজন, যেখানে বৃষ্টি-বেদনার ফরিয়াদ, খনি ও খননের অসীম সম্ভাবনা। হয়তো আমরা পাইনি রকমারি দর্শনের মৈত্রেয় মিতালি। তবু নানান দিক হতে বিবিধ উৎসের আলোক সম্পাত করে, স্বপ্ন আর বাস্তবের সে এক মহাকাব্যের যষ্টিমধুর সীমিত আস্বাদ দিয়েছেন তিনি আমাদের।

মন্তব্য: