বিধান সাহা-র কবিতা নিয়ে আত্মোক্তি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

গালিব রহমান

কবিতার কথা বলা দুরূহ কাজ। ছক ও ছন্দ পাল্টে কবিতা ভিন্নভাবেও উপস্থিত হতে পারে। দুইপৃষ্ঠার টানা একটা লেখা কারও কাছে মনে হতে পারে নিবন্ধ, কারও কাছে কবিতা। কেউ বললেন, এটা না-কবিতা না-নিবন্ধ, অন্য কিছু। কবিতা কী তা সংজ্ঞায় নির্ধারণ করা কঠিন। প্রাজ্ঞজনেরা নানাভাবে তা ব্যক্ত করেছেন। সমালোচক বা পাঠকের বোধেরও ভিন্নতা আছে। আমার যে উপলব্ধি তার কিছুটা আভাস তো দিতে হয়। কবিতার সমালোচনা করার জন্য যে পা-িত্য দরকার তা আমার নেই। গভীরে প্রবেশ করা তো দূরে থাক, উপরে ফু দিয়ে কিছুটা কম্পন জাগাবার চেষ্টা করবো। কবিতার ভেতরে থাকে অনেক রঙ, আলো ও ছায়া। চিত্রটা ঠিক স্থির নয়, স্বপ্নদৃশ্যের মতো। কখনো বিক্ষিপ্ত কল্পচিত্রের বিমূর্ত ক্যানভাস। পঞ্চইন্দ্রিয়ের বাইরেও কবির আলাদা একটা ইন্দ্রিয় থাকে। নচেৎ সে অন্যের থেকে আলাদা কিসে। সে কী জন্মসূত্রে পাওয়া, নাকি অভিজ্ঞতা ও যাপনের ভেতর থেকে সৃষ্ট, সে এক বিস্ময়! অতীত কিংবা বর্তমানের ঘটনা বা রটনায় দৃশ্যের একটা আলো কবিকে আবেশী করে। সে আবেশের সুরে বশ করে দেওয়া দেহের ভেতর যা তড়পায় তা মূলত ধ্বনির গুঞ্জন, শব্দের ডালি হয়ে ভাষা পায় কবিতায়। কবিতা অভিজ্ঞতার নতুন বোধে পাঠকের শিরায় ছোটে আলোর স্ফুলিঙ্গ। বুঝে ও না বুঝে যদি মস্তিষ্কে স্তনিত হয়, একটা উদাস কিংবা উল্লাসে মনের রঙ বদলায় তবে ধরে নিতে পারি কবিতা মৌলিক ও সফল।

তরুণ কবি বিধান সাহার কবিতা বিচ্ছেদ ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থেকে উদ্গত অনুষঙ্গযোগ, যেখানে প্রেমই প্রধান। ব্যক্তিগত ও সামাজিক উত্তোলন, স্মৃতির আলোড়নে আধুনিক অনুযোগ, ভবিতব্য সান্ত¦না ছড়িয়ে আছে কোথাওবা জোনাক-আলো খেলা করে। কবিতাগুলোতে স্বাভাবিক ভালোলাগা তৈরি হয়। কবির চিন্তার জগৎ ও বর্তমান পরিস্থিতির হাল সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। 

‘অব্যক্ত সন্ধির দিকে’ শিরোনামের সনেটগুলোর দিকে তাকালে দেখি ফুরিয়ে যাওয়া শৈশবের আহাজারি, কৈশোরের যৌনগন্ধি স্মৃতিগুলোর তাড়না, আর যৌবনে উপদেশাশ্রয়ে জাবর কেটে সান্ত¦না প্রাপ্তি। কবিতায় সুর ছন্দ ও ঢঙ হয়তো আলাদা কিছু নয়, যা আরো অনেক কবির কবিতায় পাওয়া গেছে। তবে এর ভাব ও চিত্রপট কবির নিজস্ব অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত। সহজেই তিনি তা ব্যক্ত করেন। সহজ হলেও, এই যে তুমি কেন্দ্রিক বাষ্পোত্তাপ তা কি একান্ত ব্যাক্তিগত তুমি? হয়তো। হয়তো সামগ্রিক হাওয়ার প্রলেপ। ফলে পাঠকের শরীর ও মনে তা ছুঁয়ে যায়। শুধু কথার গুঞ্জন নয়, কর্ষণেরও প্রয়োজন। সে কর্ষণ শরীর ও মনের সমন্বয়ে না হলে বিকল্প স্বাদ পাওয়া যায় না। এইসব বলেছেন কবি প্রিয়মুখের দিকে তাকিয়ে, যেখানে বেদনার ভাষা দেখেছেন। আর বার বার স্মৃতিরা ফিরে এসেছে ‘সদ্য বিধবা নারীর মতো’। অনুযোগগুলো পত্রযোগে পাঠাতে চান ‘তাহাদের দেশে’। তাই তিনি মাঝরাতে ছেড়ে দেবেন ‘জালালি কৈতর’। এইখানে ‘তাহাদের দেশ’ বলতে কোন দেশ, কাদের দেশ তা নির্দিষ্ট নয়। পাঠককে ভাবতে হয়। ধরে নিতে পারি তা স্বপ্নের দেশ। যেখানে স্মৃতিরা খেলা করে নক্ষত্রের সাথে। প্রথম দুটি সনেটের শেষ বাক্যে সিদ্ধান্তের আদলে অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে- ‘আজ তাই মাঝরাতে ছেড়ে দেব জালালি কৈতর।’ ‘যে গেছে ভুলের দেশে- যাক- আমি প্রাণ খুলে রাখি!’ তৃতীয় সনেটের শেষে তিনি উপদেশযোগে সান্ত¦না এনেছেন- ‘স্থির হও, স্থির হও, হও আরো রূপালি নীরব!’ সনেটের ব্যাকরণগত ব্যাখ্যায় দৃষ্টি দিইনি, তা আমার কাছে বাতুলতা। দেখেছি কবির ভাব ও অঙ্কন কবিতার ভূমিতে কীভাবে চিত্রল হলো। কবিতার তৃতীয় স্তবকে কিছুটা মরমী সুর খেলা করে। ছলনাভয় উতরাবার মন্ত্রণা দেখা যায়- ‘ভেবো না, সমুখে সান্ত জলাধার পাবে তুমি/ জাদুর পাথর পাবে, আর পাবে আয়নামহল’। এই কবিতা তিনটি পড়তে পড়তে কেনো যে আল মাহমুদকে মনে এলো! কোথাও কি মিল আছে?

‘নিয়তি’ কবিতায় একটা যন্ত্রণা আছে, জ্বালা আছে। যা ক্রমাগত প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কবি স্থিরতায় প্রবেশ করেন। হয়ে ওঠেন ধ্যানী। আর তখনই তিনি নিয়তিকে দেখেন ‘স্মৃতিময় আরশিতে’। এ কবিতায় ‘তুমি’ নেই, আছে ‘সে’। এই ‘সে’ হয়তো তৃতীয় কেউ কিংবা কবি নিজে। কবিতার দ্বিতীয় লাইনে আমার খটকা তৈরি হয়, বাক্যপেলবতায় ধাক্কা আসে। ‘উড়ছে উড়ছে হাওয়া আর জলের ভেতর দিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে-’ 

‘গান শুরু হোক’ কবিতাটি প্রথম পড়তে গিয়ে কেমন দুর্বল মনে হলো। মাঝখানের চারটি লাইনের শেষে- রেখেছি, ছেড়েছি, ধরেছি, রেখেছি, এইভাবে অন্ত্যমিল ঘটেছে। পুরো কবিতায় অন্ত্যমিল বা মধ্যমিলের কোনো ছড়া কাঠামো নেই। কবিতাটি যখন বার বার পড়লাম তখন এটি সবল কবিতায় ধরা দিল। কবিতাটির একটা তাল আছে। স্বরবৃত্ত ছন্দে কোথাও খটকা নেই। দেহ দিয়ে শুরু দেহ দিয়ে শেষ। মাঝখানে যে পারিপার্শ্ব দৃশ্যকল্প ও ভাবের ব্যঞ্জনা তা রসযুক্ত কর্ষণের চিত্র।

‘নৈশ শোক’ কবিতায় বিষণœ বেদনার ছায়া। সংক্ষিপ্ত কবিতার ছোট্টো দৃশ্যে বৃহৎ গল্প ঝুলে আছে। শুরুর লাইন থেকে পাঠক অনেক কথা ভেবে নিতে পারেন- ‘একটি টিস্যুপেপার অবহেলায় পড়ে আছে’।

‘সোনাই-মাধব’ কবিতায় স্মৃতিযোগে প্রেমের অনুরাগ ফুটে ওঠে। আবেগি কথার তোড়া প্রিয়ার উদ্দেশে ছুড়ে দেন হাওয়ায়। কবিতায় অলস ঋতুর চিত্র, যে সময়ে স্মৃতি আওড়ানো যায়। ‘সোনাই-মাধব’ লোকউপাখ্যানের চরিত্র। এই কবিতায় কবি নিজেকে ঐ চরিত্রের ভেতর দাঁড় করাতে চেয়েছেন। বৈদিক চরিত্রও কবিতায় প্রয়োগ হয়েছে- ‘গায়ত্রী-গদাধর’।

‘পুড়ছে অবিরাম’ ও ‘মায়ের মৃত্যুর পর’ কবিতা দুটিতে বিয়োগ-বিচ্ছেদে যন্ত্রণা-অনুষঙ্গ। মা হারানোর বেদনা ফুরাবার নয়। চিতার আগুন নিভে গেলেও অন্তরের দহন চলতে থাকে। বাস্তবতার ভেতর জীবন তবু চলে শূন্য ও অন্ধকারকে ঘিরে। সাবলীলভাবে কথার শৈল্পিক বুনন আছে কবিতায়। 

‘(বি)স্মরণ’ কবিতার শিরোনামেই দ্বৈততা। ‘বি’ উপসর্গ এখানে ব্রাকেটবন্দী। কবি কাউকে স্মরণ করছেন বিস্মরণে। ‘তোমাকে’ সম্বোধনটা হতে পারে কোনো মানবী, সমাজ, হয়তো ঈশ্বরও। এখানেও শোক ও যন্ত্রণা। ‘যেহেতু কিছুই নেই, সমস্ত আঁধার-’ কিংবা ‘তবু প্রচ- নগরে ভোর হলো, দ্যাখো, এই মৌন শবাধার!’ এইসব বাক্যে সভ্যতার পেছনে ব্যর্থতা, সামাজিক করুণ চিত্র ধরা দেয়। তবু কবি লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাইছেন- ‘আমি তবু যাব, অনু, যাব ঠিক দেখো-/ উত্তরে না থাক যদি, প্রত্যুত্তরে থেকো।’

কবিতাগুলোয় সামগ্রিক কোনো বদ্ধতা চোখে পড়েনি, স্বাভাবিক পেলবতা আছে। পাঠক মস্তিষ্ক ও দৃষ্টির আরাম দিয়ে পড়তে পারেন। ভালো-মন্দ বিচারের দায় কিংবা গ্রহণ পাঠকেরই। 

মন্তব্য: