বীরেন মুখার্জীর কবিতা : বিমূর্ত বােধের ম্যুরাল

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

অনুপম হাসান

বীরেন মুখারজী (জ.১৯৬৯) বয়সে তরুণ। কাব্যযাত্রাও বেশি দিনের নয়, নব্বই কালখণ্ডে। কবির দুটো কাব্যগ্রন্থ হাতে পাওয়ার আগেই বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় তার কবিতায় নজর পড়েছে, আকর্ষণও করেছে। সেই পাঠের সূত্রে কবির দ্বিতীয়

কাব্যগ্রন্থ ‘প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস’ (২০১০) শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি দিয়েই আলােচনায় প্রবেশ করা যাক। এ কবিতায় চিরন্তন এক বিরহী কবির সন্ধান মেলে যিনি জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অতিবাহিত সময় কিংবা অতীতের ভুলত্রটি নিয়ে আক্ষেপ করেছে এই বলে : ‘দোষ ছিলাে কার?’ যারই থাক না কেন, দোষ-ক্রুটি-যে যাবার সে তাে চলেই গেছে। তারপরও বিরহীমন বাঁধ মানে না, ভাবে-ফিরে ফিরে যদি আসে মাতাল বাতাস।’ স্মৃতিমেশা এই পবন হয়তাে জুড়াতে পারবে না বিরহীর তপ্ত দেহমন; তারপরও সেইসব স্মৃতির ভেতর ঘুরে বেড়াতেই সুখ বােধ করে বিরহী প্রেমিক কবি বীরেন মুখার্জী। কবির এই বিরহী প্রেমিক স্বভাব এ গ্রন্থের প্রায় সব কবিতায় কমবেশি ক্রিয়াশীল আছে। এ ব্যাপারে প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস’ গ্রন্থের শেষ কবিতার শেষ ও স্তবকটি পাঠকের সামনে তুলে ধরলে বক্তব্যের সত্যতা উপলব্ধি করা সম্ভব।

তােমাকে দেখে দেখে পান করতে শিখেছি নীল গরল;

আমার বুকের জমিন এখন ক্ষয়িষ্ণু ট্রয় নগরীর শূন্য ছায়ালিপি,

বিবর্ণ ক্যানভাস… (এলিজি-০২, পৃ.৬২)

‘ক্ষয়িষ্ণু ট্রয়’ যখন বীরেন মুখার্জীর হৃদয় মন্দির তখন রচিত হয়েছে ‘প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলি। যার অনিবার্য পরিণাম হিসেবে এ গ্রন্থের কবিতায় বিরহের সুর অতিমাত্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অন্যভাবে বলা যায়, বীরেনের এ কাব্যের কেন্দ্রভূমে রয়েছে প্রেম ও বিরহের কথা। বলা যায়, এ গ্রন্থের প্রায় সবগুলাে কবিতায় প্রেম আছে, মিশে আছে বিরহও। বলা দরকার, কবি বীরেনের প্রেম একদিকে যেমন রােমান্টিক চেতনায় কল্পনার ডানায় স্বপ্নচারী হয়ে প্লানচেট ভাের আহ্বান করেছে তমনি জাগাতিক কামনা বাসনায়ও উদ্দীপ্ত হয়েছে অবলীলায়। যেমন :

তরল কামনা ভেজা বসন্তের বাহুলগ্না রাত কিংবা

মাখন জোছনার সাম্পানে দোলা জোনাক প্রহরের নির্জনতায়

তােমার শিল্পময় শরীরী ভাষায় খুঁজেছি তিন জীবনের ওম

তােমাতেই নিমগ্ন সারাক্ষণ এটুকু ব্যতিক্রমতায়

প্রেক্ষাপট বদলে ফ্যালাে তুমি আবহসংগীতে

নিখুঁত কারুকার্যে ঠকিয়ে যাও আমাকে… নিজেকেও। (শরীরবৃত্তীয় পাঠ, পৃ ৫১)

বীরেন মুখার্জীর প্রণয় যেমন কল্পনার ডানায় আকাশ পরিভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে পারে তেমনি লৌকিক জগতের দেহঘরেও চুকে পড়ে লাজলজ্জাহীন। এ দশকের কবিতায় প্রেমের প্রবল দেহীরূপ ও উচ্চমার্গের রােমান্টিক অস্তিত্ব স্বমহিমায় বিদ্যমান। বে কবি নারীপ্রেমে বিভাের হয়ে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার খোঁজে ‘প্লানচেট ভােরে’র অপেক্ষার বিমূর্ত সবুজ মুরাল হয়ে অপেক্ষার প্রহর গণনা করেন-সেই কবিই আবার দেখেন:

সহাস্য বসনে বাড়ে মানুষের চাষ

নারীদের সার্বভৌম রােদের শরীর 

নরম আলাে গায়ে মেখে

পিক আওয়ারে বিক্ষুব্ধ হয় সংস্কার বিবাদে (জীবনের সরল শুন্যতা, পৃ ৫২)

প্রসংগত এখানে উল্লেখ্য, প্রেম-বিরহ বিষয়ে বীরেন নানা বিষয়াদি প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরতে গিয়ে নারীকে দেখেছেন নদীর সমান্তরাল প্রকৃতি হিসেবে। তার কথায় নারী ও নদী বিবর্ণ হয় সভ্যতার রিহার্সেলে। একথা আংশিক সত্য, পুরোপুরি সত্য মনে করার কোনাে কারণ বা যুক্তি নেই। যেহেতু ক্রমবিকাশমান সভ্যতা যতো সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ততােই প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচার বাড়ছে। এর অনিবার্ষ ফল হিসেবে আমাদের নদীমাতৃক জন্মভূমি বাংলাদেশের নদীগুলােও হারিয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে সভ্যতার গর্ভে। কিন্তু সভ্যতার সাথে সাথে নারী কিভাবে বিবর্ণ হতে পারে তা ঠিক আমাদের বােধগম্য হয় না। যদি এখানে সভ্যতা অর্থে সময় গ্রহণ হয়-  তাহলে বলা যায়, সময় গড়ালে নারীর যৌবনবর্তী দেহের রূপ লাবণ্য সৌন্দর্য ক্রমাগত বিবর্ণ ও বিলীন হয়ে যায়। একথা শুধু নারীর ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য- সমানভাবে বিবর্ণ হয় পুরুষও। অতএব কবির নদী ও নারী বিষয়ক তত্ত্বটি বিভ্রান্তিমূলক, যা যৌক্তিক

বিবেচনায় মেনে নেয়ার কোনাে সুযােগ নেই।

সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি। আর যারা কবি, তারা আর দশজনের চেয়ে একটু আলাদা হবেন এটাই স্বাভাবিক। জীবনানন্দ দাশ একবার বলেছিলেন, “নিজের মুদ্রাদোষে আমি সকলের মাঝে হতেছি একেলা।”  কবিদের ক্ষেত্রে এরকম ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। শুধু জীবনানন্দ দাশই নন, সম্ভবত সকল কবিই কমবেশি একাকীত্বে ভােগেন। নৈঃসঙ্গ্য বা এলিয়েনেশন প্রায় সকল কবিকেই কোনাে এক সময় গ্রাস করে। কবি বীরেন মুখার্জীর ক্ষেত্রেও ঘটেছে এলিয়েনেশন যন্ত্রণা ।

অথচ এই দ্যাখাে, কোজাগরী জ্যোৎস্নার পালক মেখে

আমি ক্যামােন একা হােয়ে আছি

কোলাহল মুখরতায় দিনের ব্যস্ততা শেষে

প্রতি রাতে একাকী সাজাই খাবার টেবিল। (পরিবর্তন, পৃ.১০)

ওপরের স্তবক থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, কবি বীরেনের মুখেও অনেক পুরাতন কথা নতুন করে অনুরণিত হয়েছে, তাকেও ক্রমশ গ্রাস নিয়েছে কবিতা এবং নিঃসঙ্গতা। ফলে তিনিও ভুগেছেন জীবনানন্দীয় ‘একাকীত্বে’র মুদ্রাদোষে। বলাই বাহুল্য, বীরেনকে যখন

কবিতা ক্রমাগত টেনে নিয়েছে, ঠিক সেই সময়ের অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে এখানে। কবি বস্তুজাগতিক বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে যুক্তিতর্কের ঘেরাটোপে নিপতিত হলেও প্রণয়ের রােমান্টিক গল্প নির্মাণ করেছেন অসাধারণ শিল্প দক্ষতায়। যেমন :

এবং শুন্যতার ভেতর তুমি আর আমি

আমাদের চরিপাশে মৃত রােদ ছুঁয়ে পুড়ে যায়

পড়শি বাতাস, (মৃত রােদ পােড়ে পড়শি বাতাস, পৃ. ২০)

কবি প্রণয় নিষ্কাম নয়, আবার রােমান্টিক চেতনাকে একেবারে ছেড়ে দিয়ে কিংবা অস্বীকার করেও তার প্রণয়ের অস্তিত্ব নয়। কলােনিয়াল সাহিত্যের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে বাঙালি কবিরা নব্বই দশকে যে শিকড় সন্ধানী যাত্রা শুরু করেছিল বীরেন মুখার্জী তারই সহযাত্রী। বাঙালির নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতি কখনােই নিষ্কাম অথবা পুরােপুরি বিমূর্ততায় আস্থাশীল ছিল না; এর স্বপক্ষে সমালােচকের মন্তব্য হচ্ছে: আমাদের ত্যাগ ও উপভাগ প্রধানতম কনটেন্ট, তবে নিষ্কাম নয় এবং তা বস্তকলাতে মূর্ত। (পাবলাে শাহি, ‘আমাদের কোড আমাদের ইশারা এবং ভাষার বিনির্মাণ”, ২০০৫) তবে বাঙালির জীবনে যে উপভােগ সেখানেও আছে রােমান্টিকতার পেলবতা :

এখন আমার দুচোখ তামার প্রতীক্ষার প্রহর গােণে,

আমি নিঃস্বতার অন্ধকার উড়িয়ে দিতে পারি অবলীলায় 

যুগল প্রহরের আবেশায়িত ওই উষ্ণ ঠোঁট ছুঁয়ে

আমি গােপন কুহেলিকায় নিঃশেষ হতে চাই

মিশে যেতে চাই বনবীথির সান্নিধ্যে, সবুজ মমতায়… (বৃক্ষ কিংবা পাখি জন্ম হােক আমার, পৃ ১৪)

প্রিয়তমাকে কাছে পাবেন বলে আনন্দে আত্মহারা কবির আবেগ বিহবল প্রেমারতির প্রকাশ লক্ষণীয় উপরােক্ত স্তবকে। বলা যায়, কবির এই প্রেম এবং প্রিয়তমাকে পাওয়ার আনন্দে তিনি এখানে তুরীয়বাদী জীবনবােধ প্রকাশ করেছেন। এই তুরীয়বাদী জীবনচেতনা নঞর্থক নয়। কারণ, প্রণয়কে ঘিরে মানুষের সব আবেগ বস্তুজাগতিক যৌক্তিক পরম্পরা অনুসরণ করে চলে না। প্রসঙ্গত এটাও সত্য যে, বাঙালির জীবনে যুক্তিবাদের চেয়ে তুরীয়বাদের ভূমিকাই প্রবল। তবে বীরেন মুখার্জী ভুলে যান নি বাঙালি জাতির শেকড়ের কথা কিংবা প্রান্তিক মানুষের জীবন বাস্তবতার কথা। এজন্যই তাঁর ‘নিরর্থক গন্তব্য’ কবিতায় তিনি বাহ্যজীবনের ও সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরে লিখেছেন:

…) চিনি নাই- জানি নাই; ক্যান্ তবে আসে

সে গেরস্থালি বুকে, কৃষ্ণবর্ণা মেঘে ভেসে নিষিদ্ধ সাঁঝে- নক্ষত্রের সাথে

জোনাকময় রাতের ধলপহরে, মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে ক্যান্ সে জেগে থাকে, নদীশাসনে চোখ মুখে বারবার ক্যান্ তার জলের কাব্য পাঠ? (নিরর্থক গন্তব্য, পৃ.১৬)

প্রান্তিক এ কথাভাষ্যে নির্দেশিত হয়েছে প্রান্তিক মানুষের অনির্দেশ্য ভবিষ্যৎ। এছাড়াও ওপরের পংক্তিমালায় আছে জীবন আর যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। জীবন এমনই বাস্তবতার নির্মম ও নিষ্ঠুর সব প্রশ্নে রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয় প্রতিনিয়ত। তারপরও সেই পথেই হেঁটে যেতে হয় কিংবা হেঁটে যেতে বাধ্য হয় আমাদের প্রান্তিক মানুষেরা।

সম্ভবত নব্বই দশকের কবিতা থেকেই বাংলা কবিতায় প্রেম ও কামের সহাবস্থান লক্ষ্যণীয়। এরই ধারাবাহিকতায় বীরেনের কবিতায়ও প্রেম ও কামের সহাবস্থান ঘটেছে যা খুব সাদা চোখেই পাঠকের নিকট ধরা পড়ে। যে কবির প্রণয় কামগন্ধহীন নয়, তারই কবিতার অন্তর্নিহিত উপলব্ধির জগতে সচেতন অথবা সুপ্তাবস্থায় বাস করে ছন্নছাড়া এক বাউল মন। আর বাউল সম্প্রদায় যে ভােগে নয়, ত্যাগে আস্থাশীল তা বলারই অপেক্ষা রাখে না। যেমন:

অন্ধকার পােড়াতে গিয়ে বহুদিন পর- গৈরিক বাউল

আদিম শৈশবে ফিরে হেঁটে চলে ধুলিচিহ্ন পথে… (অন্ধকার পােড়াতে এসে, পৃ.২৫)।

বাউল বােধ, বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যিক চেতনা, পশ্চিম থেকে ধার করা কোন জীবনদর্শন নয়। পােস্ট কলােনিয়াল বাংলা সাহিতে্য মূলত বাঙালি চেতনা এবং স্বীয় শিল্প সংস্কৃতি বােধের উদ্বোধন শুরু হয়েছে। এজন্যই কবি অবলীলায় বাউলপনায় নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়ে ছন্নছাড়া জীবনের মায়াবী টান অনুভব করেন।

আমাদের হিমায়িত স্বপ্নগুলাে দীর্ঘ রাত্রিকামী হলে

অক্ষমতাগুলাে দিয়ে আমি একটি মালা গাঁথবাে

নিবিড়তায় গাঢ় ইতিহাস থেকে খসে পড়া অনুভূতির পলিতে

নির্মিত হবে তখন একটি বিশ্বস্ত সিঁড়ি; (একদিন তােমাকে বলতে হবে, পৃ.১১)

বীবেন মখার্জী হয়তাে সচেতনভাবে বাঙালি জীবনের বাউলপনা আরােপ করেছেন। কিন্তু একথা সত্য একজন কবির অন্তর্গত চেতনার অনিবার্য সূত্রে গ্রন্থিত থাকে বােহেমিয়ান জীবনবোধ ও সংসার থেকে পলায়নপ্রবণ মনােবৃত্তি। আমার আলাে, আমার আঁধার

কবিতায় সেই বােহেমিয়ান কবিজীবনের কথা ব্যক্ত হয়। যতই ছন্নছাড়া আর উদাসী হােক একজন কবি, তারপরও যন্ত্রযুগের বাস্তবতাকে অস্বীকার করে শুধুই কাব্যধ্যানে মগ্ন থাকার যে উপায় নেই সে কথাও জানেন বীরেন। তাকেও আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতাে ক্ষুধার অন্ন জোটাতে ছুটতে হয় কর্মের খোঁজে :

পথে পথে কর্মই মানুষের আজীবন সঙ্গী থাকে

জেনেছি, কর্মই রচনা করে আলাে-আঁধারের পটভূমি

আমার যা কিছু আলাে, যা কিছু আঁধার

উদাসীন শুয়ে থাকে স্মৃতির ম্যাপে; (আমার আলাে, আমার অধার, পৃ.১৭)

প্রেম আর বিরহ, পাওয়া আর না পাওয়া-এসব দৈনন্দিন জীবনের অমসৃণ বাস্তবতা। হাত ছুয়ে চোখে চোখ রেখে যে প্রণয়কে একদা স্বর্গের শেষ সিঁড়িতে নিয়ে যাওয়ার দৃপ্ত প্রত্যয় জাগে মানুষের কণ্ঠে, তা বাস্তব জীবনের আঙিনায় অনেক সময়ই ধরা দেয় না। আর তখনই বুকের গভীরে বাজে বেদনার বাঁশি। এই বিরহ বােধ সম্ভবত প্রণয়ের সূচনাতেই সুপ্ত থাকে। কিন্তু অদ্যাবধি কোনাে পরিমাপ যন্ত্র আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি যা দিয়ে মানুষের প্রণয়কে মাপা যায়। তারপরও মানব-মানবীর প্রণয় সম্পর্কে এই পরিমাপের প্রশ্নটি এসেই যায়। প্রেমিক কবি যখন প্রিয়তমার নিকট থেকে অক্ষমতার শত অভিযােগ শুনে রক্তাক্ত হয়েছেন-তখন প্রিয়তমাকে তার ভালােবাসার বিশাল ব্যাপ্তিকে বুঝে নেয়ার জন্য পরিমাপক যন্ত্রের কথা বলেছেন। আর তখন হয়তাে প্রিয়তমা নির্মাণ করতে পারবে ‘বিশ্বস্ত সিঁড়ি’; যা দিয়ে জীবন বৈতরণী পার হওয়া যাবে। ‘অসম্পূর্ণ গন্তব্যের পথে’ শীর্ষক কবিতায় কবি বিরহের তাপে দগ্ধ হলেও তার কণ্ঠে আছে আশা জাগানিয়া উচ্চারণ:

সব ফেরা পরাজয়

নয় এ সত্য জেনাে! (অসম্পূর্ণ গন্তব্যের পথে, পৃ.৯) 

এটা সাধারণভাবে রণকৌশলও বটে, পূর্ণোদ্যমে শত্রুর মােকাবেলা করতে হলে কখনাে কখনাে পিছনে যেতে হয়। প্রণয়যুদ্ধে ব্যর্থ হবেন না বলেই তিনি এখানে পিছু হটেছেন-পুনরায় ফিরে আসবেন এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাবেন এমন প্রত্যয় নিয়ে। 

প্রেম-বিরহ অথবা রােমান্টিকতার সঙ্গে কবিমানসে প্রগাঢ় মমতায় জড়িয়ে আছে প্রকৃতিচেতনা। প্রকৃতির রূপ, রঙ আর ঐশ্বর্য কবির দৃষ্টিতে স্বতন্ত্র নান্দনিক মাত্রায় উদ্ভাসিত হয়েছে কবিতায়। কবি দেখেন-শসাের অভাবিত মায়া’; কিংবা ‘ফলবতী বৃক্ষের আর্তনাদ’, কুয়াশা চাঁদ ঘুমন্ত মাছেদের চোখের ভূগােল। বাংলা-প্রকৃতির এসব শিল্পিত দৃশ্যাবলির পথ ধরে অবচেতনেই হেঁটে যান-বৃষ্টি ভেজা অবাধ্য জোছনায়’। তার প্রণয়ের চিহ্নপর্ব (২০০৯) কাব্যগ্রন্থের নাম শীর্ষক কবিতাটিও চিত্রকল্পময়। যেমন:

অভিমানী কষ্ট পােষে রূপালী নদীর ঢেউ-হােমের আরতী মুখস্ত 

করে নেয় হেমন্তের বিবর্ণ মাঠ, চিহ্নপর্বের গােপন আঁধারে কেনাে আজ

দাসখত মাখে রােদের সংস্করণ? (প্রণয়ের চিহ্নপর্ব, পৃ.১৫)

উপরােক্ত স্তবকে যে অসাধারণ চিত্রকল্প নির্মিত হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এ চিত্রকল্পে উঠে এসেছে প্রেমিক এক যুবকের আবেগ বিহবল হৃদয়ের আবাহন। প্রথম প্রণয় এবং আবেগ এ কবিতাটিতে ঠাসাঠাসি করে সামাগ্রিকভাবে চিত্রকল্পময় হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত বলা দরকার, প্রকৃতি দেখার যে চোখ বীরেন ব্যবহার করেছেন তা সাধারণ আর পাঁচজনের চোখের মতাে নয়; তার দৃষ্টিগ্রাহ্য দৃশ্যাবলি কাব্যবর্ণনায় বাকপ্রতিমায় কখনাে-বা চিত্রকল্পময় হয়ে পাঠকের সামনে লৌকিক জগতের অধিক এক আবেদন সৃষ্টি করে, যা হয়তাে কোনভাবেই বস্তুগত নয়। যেমন :

শব্দের হৎপিণ্ড- ফুঁড়ে ফেরার সময় দীর্ঘ হলে

আকাশ তার বায়বীয় পাখা মেলে ধরে

উৎসব মােহনায়! (নিষিদ্ধ জ্যোৎস্নার গান, পৃ.৩৫)

অথবা,

পরিবর্তন ছুঁয়ে যায় আমাদের ইচ্ছের রেখাগুলি

সংকল্প বিভায় নতমুখ হাঁটে সাধ ও সাধ্যের ঘ্রাণ

কাব্যসন্ধির আবেশী ঘুমচোখ ঐশ্বর্যের ঐক্যতানে

জেগে থাকে প্রতিবেশি শয্যায়… (সাধ্য ও সাধ্যের ঘ্রাণ, পৃ.৩৬)

এভাবে উদাহরণ দেয়া হলে বীরেন মুখার্জীর প্লানচেট ভাের কিংবা মাতাল বাতাস কাব্যগ্রন্থ থেকে অসংখ্য বাক্প্রতিমার উদাহরণ দেয়া সম্ভব। শুধু বীরেন মুখার্জী নয়, নব্বইয়ের কবিদের রচনায় যথেষ্ট পরিমাণে চিত্রকল্পের ব্যবহার লক্ষণীয়। কবিতার মূল ধারাকে অনুসরণ করেই বীরেন মুখার্জীর কাব্যযাত্রা শুরু। কবির প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থের কবিতাবলিতে একজন প্রকৃত কবির যথেষ্ট উপাদান নিহিত আছে। আমার প্রত্যাশা, কবি ক্রমাগত কবিতার নান্দনিক পথে হাঁটবেন এবং বাংলা কবিতাকে ঋদ্ধ করবেন।

মন্তব্য: