শহীদ কাদরীর কবিতাঃ কবিতায় নান্দনিক প্রত্যাবর্তন

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

তুষার প্রসূন   

মহাকালের আকাশে কাব্যতিলক সেটে দিতে শহীদ কাদরী ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট চেতনায় কবিতা লুকিয়ে পৃথিবী পরিভ্রমণে এসেছিলেন এবং সেটা যে কাব্যকেন্দ্রিক পরিভ্রমণ ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাযাবর জীবনে তিনি বাংলাদেশ, ভারত সহ লন্ডন, জার্মান আবার কখনও নিউইয়র্কে থেকেছেন। কবিতাকে না ভুলে কবিতাকে করেছেন সহযাত্রী। ১৪ বছর বয়সে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।  ১৯৬৭ সালে পঁচিশ বছর বয়সে প্রকাশ করেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার’। এরপর ১৯৭৪ সালে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ এবং ১৯৭৮ সালে ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’। বাংলা কাব্য-সাহিত্যের ভুবনে তিনি শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছেন তিনটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। ৩১ বছরের একটা দীর্ঘ বিরতি শেষে ২০০৯ সালে ৩৬ টি কবিতা নিয়ে ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ প্রকাশ করলেন। কবিতায় নান্দনিক প্রত্যাবর্তন করলেন তিনি। একাগ্র ও নিমগ্ন চিত্তে কবিতা লিখলে হয়তো এক জীবনে অনেক অনেক লেখা যায় কিন্তু ধ্রুপদী সাহিত্য রচনার জন্য তা হয়ে ওঠে আংশিক সত্য। শহীদ কাদরী তার প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে দাপটের সাথে লেখনী শক্তির স্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘উত্তরাধিকার’ কাব্যগ্রন্থের ‘বৃষ্টি বৃষ্টি’ কবিতা, ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কাব্যগ্রন্থের ‘তোমাকে অ: প্রি:’, ‘স্কিৎসোফ্রেনিয়া’, ‘কোথাও ক্রন্দন নেই’ কাব্যগ্রন্থের “তুমি গান গাইলে” কিংবা “আবুল হাসান একটি উদ্ভিদের নাম”, “সঙ্গতি” এবং “আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও” কাব্যগ্রন্থের “একে তুমি একুশের কবিতা বলতে পার” কিংবা “তাই এই দীর্ঘ পরবাস” সহ অনেক কবিতাই আজ বাংলা ভাষাভাষীদের প্রাণের কবিতা হয়ে উঠেছে। 

কবির সংগ্রাম আমৃত্যু বহমান, কবিকে কোন নির্দিষ্ট ফ্রেমে আবদ্ধ করাও শোভন নয়। এছাড়া শক্তিশালী কবির কোন দশক নেই, শতক নেই, নেই কোন সীমারেখা। কবিরা মহাকালের। তবু শহীদ কাদরীর কবিতার পাঠ পরবর্তী আলোচনার সুবিধার্থে তাকে ষাট এর সময় পর্বের কবি বলে আখ্যায়িত করা হয়, যদিও তার কবিতাগুলি অত্যাধুনিক। ইউরো-আমেরিকান বলয়ে তার জীবনের অনেক সময় কাটলেও তিনি কাব্যরচনায় থেকেছেন প্রভাবমুক্ত, মৌলিক। অনেকক্ষেত্রে সমসাময়িক সময়কে আধুনিককাল বিবেচিত করা হলেও কালের বিচারে যে কবিতাগুলো মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত থাকে সেগুলোই আধুনিক। বায়রণ, বোদলেয়ার, র‌্যাবোসহ ইংরেজি সাহিত্যের অনেক কবি তাদের সময়ে যেমন আধুনিক ছিলেন আজও তেমনি রয়েছেন। শহীদ কাদরীর পাঠকদের সবসময় ভাল কবিতাগুলো উপহার দিতে চেয়েছেন, ফলে মেধা থেকে নিংড়িয়ে আমাদের সামনে তুলে এনেছেন তার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে তিনি ভিন্ন মেজাজে যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন তার নাম “আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও।” গ্রন্থটির প্রথম কবিতা “স্বতন্ত্র শতকের দিকে” অভিযোগের ভারে সিক্ত। কবিতায় তিনি বলেছেন, “শতবর্ষ পরমায়ু নয় যে আমার কবিতা তা জানি/ তবু আমার নিজস্ব শতকের গোধূলির দিকে তোমার মতন অগ্রসরমান আমিও/ এবং সেইসঙ্গে দেখে যাই অস্তরাগ মানবিকতার।” উল্লিখিত কবিতায় ‘মানবিকতার অস্তরাগ’ শব্দের রেশ কবিতাটির পুরো অংশ জুড়ে রয়েছে। একই কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে “এক রঙবেরঙের শতচ্ছিন্ন তালি-মারা জনগণতান্ত্রিক জামা পরে আছি আমরা” এবং “গণতন্ত্রের ক্ষয়িষ্ণু স্বাস্থ্যের ওপর আস্থা নেই আর” এমন কিছু কষ্টময় অভিব্যক্তিও লক্ষ্যণীয়। আমরা পৃথিবীর সবখানেই দেখছি অস্ত্রের মহড়ায় গণতান্ত্রিক চর্চা আজ গোলটেবিল বৈঠকে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সমাজতন্ত্রের উত্থানও মুহূর্মুহূ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে সুস্থতার অবস্থান এখনও অনেক দূরে।

প্রবাস জীবন যতই দীর্ঘ হোক একজন মানুষ কখনোই ভুলতে পারেন না তার প্রিয় স্বদেশকে। স্বদেশ যেন এক অদৃশ্য প্রেমিকা। প্রতিনিয়ত তার ভালোবাসা অনুভূত হয়, ইচ্ছে হয় ভালোবাসতে, ভালোবাসা পেতে। আর একজন কবির পক্ষে এমন উপলব্ধি তো খুব করেই জেগে ওঠে- “হে নবীনা, এই মধ্য-ম্যানহাটানে বাতাসের ঝাঁপটায় তোমার হঠাৎ খুলে যাওয়া উদ্দাম চুল/ আমার বুকের ’পর আছড়ে পড়লো/ চিরকালের বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতন।” [আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও]। স্বদেশের প্রতি কবির কৃতজ্ঞতাবোধ প্রতিনিয়ত টের পাই তার এযাবৎ লেখা প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে তাই তার স্বদেশপ্রেম নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা তবু তার সরল সুন্দর উচ্চারণ একটু আধটু বর্ণনা না করে পারা যায় না, “বরং এদিকে এসো/ তোমাকে শেখাই অ-আ-ক-খ/ হে চড়–ই বলো, বাংলা বলো।?”[ প্রবাসের পঙ্ক্তিমালা]। কবি সুদূরে থেকেও আমাদের সঠিক পথের নির্দেশ দিয়ে চলেছেন কিন্তু আমাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ কই! তিনি “কোথায় প্রবেশাধিকার” কবিতায় বলছেন,“তোমরা তো এখনো সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে পারলে না,/ পরিভাষার অভাবে শিল্পনীতি, রাজনীতি ও সমাজনীতি সবই ইংরেজিতে চলছে জোরেশোরে-… …।”

শহীদ কাদরীর কবিতা দর্শননির্ভর চিন্তা, স্বদেশিকতা, বিশ্বজনীনতা নিয়ে রচিত। সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং অসাম্প্রদায়িকতাকে তিনি তার কবিতায় নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। ‘তুমি’ কবিতায় তিনি বলেন, “মার্ক্সবাদী বিপ্লব অর্থাৎ অনবরত গণ-অভ্যুদয় ছাড়া আমাদের এই বিব্রত তৃতীয় বিশ্বে অন্য কিছু কবিতার বিষয় বা বস্তু হতে পারে না কিছুতেই।- এইটুকু লিখে আমাকে থামতে হলো।” অন্য একটি কবিতায় তিনি বলেন, “দু টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকি ভরা এবং নক্ষত্রকুচির মন কিছু লবণের কণা/ দিগন্তের শান্ত দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে-/ তাই এই দীর্ঘ পরবাস।” “তাই এই দীর্ঘ পরবাস” কবিতার শেষ লাইনে উল্লেখ করেছেন, “চিরকাল পরবাসী আমি স্বদেশে-বিদেশে।” স্পষ্টভাষায় রচিত পঙ্ক্তিগুলো তার স্বতন্ত্রসত্তার পরিচায়ক। ব্যক্তিজীবনের বিশেষ মুহূর্তগুলো কখনও কখনও হয়ে ওঠে সর্বজনীন। এক এর মধ্যে বহু-র সন্ধান শহীদ কাদরীর সফল পঙক্তিগুলোতে ফুটে ওঠে। প্রিয় জন্মভূমির সঙ্কট ও সম্ভাবনার মধ্যে গড়ে উঠেছে যে জীবনবোধ তা কবির চিত্তচাঞ্চল্যের কারণও। পাশ্চাত্যঘেঁষা জীবনচর্চায় জীবনযাপন করলেও তিনি আপাদমস্তক বাংলাদেশের কবি হয়ে রয়েছেন। বিষ্ময়করভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন দেশপ্রেমিক যারা তারা বিশ্বকেও ভালবাসতে পারে। তিনি কখনই ভুলে যাননি একুশ বাংলাদেশের অহংকার, একুশ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের শিল্পিত রুপ। কবি “একে বলতে পারো একুশের কবিতা” কবিতায় বলেছেন, “এই কবিতাটি সরাসরি একুশের কবিতা নয়/ কিন্তু যদি তুমি অপলক তাকিয়ে থাকো এই শব্দমালার দিকে,/ তুমি দেখতে পাবে এই কবিতার ভেতর ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে শ্রাবণের রাঙা জল- একে তুমি একুশের কবিতা বলতে পার।”  অথবা “রীতি বিষয়ক কয়েকটি পঙক্তি” কবিতায় তিনি বলেছেন,“আকাশ নিজস্ব রীতি জানে/ তাই সে কেবল নীল থেকে নীলাভতম হ’য়ে চলেছে দ্বিধাহীন;/ নদী জানে তাকে জোগাতে হবেই তৃষ্ণার্তকে জল, মৎসকুলকে দিতেই হবে খুলে তার তরঙ্গায়িত জলজ স্তন;/ আর হাওয়ায় সওয়ার হ’য়ে বৃষ্টি যখন দিগন্ত থেকে অগ্রসর হয় আমাদেরও এই বিহ্বল গ্রহের দিকে,/ তখন কোন জননায়ক কিংবা স¤্রাটের নির্দেশ ছাড়াই তোমার বাগানে নেচে ওঠে একাকী ময়ূর।” কবি কেবল বাংলাদেশ তথা পৃথিবীবাসী মানুষের মুক্তি বা শুভকামনাই করেননি তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছেন তার কবিতায় খুব স্পষ্টভাবে। বলেছেন- “এই গ্রহের মহাপুরুষেরা কে কী বলেছেন আপনারা সবাই জানেন/ এখানে বক্তৃতা আমার উদ্দেশ্য নয়/ আমি এক নগন্য মানুষ/ আমি শুধু বলি: জলে পড়ে যাওয়া ঐ পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন/।”

শহীদ কাদরী প্রবাদপ্রতীম কবি। ১৯৪৭-এর দেশভাগ, ৫২-র ভাষা আন্দোলন, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এ সবকিছুরই তিনি নীরব স্বাক্ষী। আজ বয়সের ভারে অথবা বলা যায় শরীরে চরম অসুস্থতার ক্ষত নিয়েও দিক নির্দেশনা দেন, স্বপ্ন দেখেন সুন্দর এক কাব্যিক পৃথিবীর। এ্যাতো আশা, এ্যাতো উদ্দিপনার মাঝেও মনের কোণে নষ্টালজিক কোন এক অদৃশ্য তীর যে বিদ্ধ হয় না তা বলি কি করে, সত্তর ছোঁয়া বয়সের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তার লেখা শেষ বইয়ের শেষ কবিতায় তিনি বলেন, “যতোবার আমি ঘরের নিকটবর্তী হই/ কুয়াশা আক্রান্ত সেই বারান্দায় রয়েছে দাঁড়ানো আজো একটি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি- একদা কৈশোরে যে আমাকে জানিয়েছিল বিদায়,/ সেই ছায়ামূর্তি আজো, এখনো, আমাকে লক্ষ্য ক’রে উড়িয়ে চলেছে একটি বিদায়ী রুমাল/”[ নিরুদ্দেশ যাত্রা]। যদিও কবির এ এক সত্য দীর্ঘশ্বাস কিন্তু কবি শহীদ কাদরীকে দেখতে পাই মানবপ্রেমে, স্বদেশপ্রেমে, পথচলার অনুপ্রেরণায়, আবিষ্কার করি একঝাঁক পাঠক ও কবিদের জমপেশ আড্ডায়। 

মন্তব্য: