শহীদ কাদরী : কবিতাধারার নন্দিত কবি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শহীদ ইকবাল

পঞ্চাশ-উত্তর কবিতায় আধুনিকতা ও নাগরিক জীবনবোধের সংযোগ ঘটিয়ে শহীদ কাদরী (জ. ১৯৪২)র আত্মপ্রকাশ। ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত তাঁর কবিতা। সমসাময়িকজ্জএ প্রবণতায়, অন্য কেউ তেমন উদ্ভাসিত নন। পুরোদস্তুর নাগরিক, প্রকাশে আধুনিক ও নিঃশর্ত নান্দনিক। বুদ্ধদেব বসুর কথায় : ‘এই ‘জীবনে’ (বা সমাজে) কবির আর স্থান নেই; একা সে, উদ্বাস্তু, স্থিতিহীন; এখন সে সার্থক হ’তে পারে শুধু নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরভাবে প্রতিবার শক্তিকে দাঁড় করিয়ে।’ এ সত্যটি শহীদ কাদরীর প্রবণতায় রঞ্জিত, ক্ষিণœতার কালে কবি আত্মবিবৃতিময় বা আত্মস্বীকারোক্তিপ্রবণ। উত্তরাধিকার (১৯৬৭) বইঘর, চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোন ক্রন্দন নেই (১৯৭৮)জ্জতিনটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করে কবিতার ধারায় তিনি স্থায়ী হন। কবিতাগুলো লেখা আর কবিতাগ্রন্থ প্রকাশের ব্যবধান আছে, পরবর্তীতে পাওয়া যায় তাঁর আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯) কাব্যগ্রন্থ। শহীদ কাদরী অন্য অনেকের মতো নগরের কবি কিন্তু ভাব প্রকাশের টেকনিকে আলাদা। তাঁর কবিতার ক্রম-উত্তরণ আছে, নিজের ভেতরের রূপান্তর ও পরিণতি সংঘটিত। প্রথম থেকে  নগরের ব্যস্ত জীবন, নস্টালজিয়া, ক্লিন্নতা, রুগ্নতা, হীনতা, অবক্ষয় ও শূন্যতার চিত্র। ‘বোদলেয়ারীয় প্রেমের আর্তিই তাঁর কবিতায় সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়’ (ষাটের দশকের কবিতা: বিষয় ও প্রকরণ: বায়তুল্লাহ্ কাদেরী)। কিন্তু কেন বোদলেয়ার? কারণ:  

    (ক)   

য়োরোপের যে-কবিরা, সদ্য আগত যন্ত্রযুগে, সমাজের সঙ্গে কবির বিচ্ছেদ বিষয়ে প্রথম সুতীব্রভাবে সচেতন হন, তাঁদের মধ্যে প্রধান পুরুষ বোদলেয়ার; তাঁর কবিতার মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেল আর্টের আধুনিক ধারণা, রূপায়িত হ’লো প্রকৃতির সঙ্গে চিত্তের সেই দ্বন্দ্ব… তাই বোদলেয়ারের কবিতা কৃত্রিমের বন্দনায় মুখর; ভূষণের ধাতু ও রত্নদাম, বসনের রেশম ও সাটিন, সুরা, সুগন্ধ, আর স্বপ্নে দেখা সেই প্যারিস, যেখানে সব উদ্ভিদ লুপ্ত হয়েছে, কোথাও আর তরুপল্লব নেই, চারিদিকে ছড়ায়ে আছে শুধু ধাতু, পাথর ও প্রদীপ্ত রত্নমণির কারুকার্য, জল পর্যন্ত তরলিত সোনা, আর কালোর মধ্যেও বহুবর্ণ বিচ্ছুরিতজ্জএই সব চিত্রকল্পের সাহায্যে সবলে প্রত্যাখ্যাত হ’লো প্রকৃতি, ঘোষিত হ’লো প্রতিভার পীড়া, নিঃসঙ্গতা ও মহিমা। (বুদ্ধদেব বসু : মেঘদূতের ভূমিকাংশ)

    (খ)

রোমান্টিক কবি বোদলেয়ার তাঁর কবিতায় এনেছেন আরও অনেক কিছুজ্জবিষাদের সঙ্গে বিষাদের বিলাসিতাজ্জসেসব আবার শেলী বায়রন ওঅর্ডসওয়ার্থ থেকে একেবারে আলাদা, এঁদের উচ্চারণ বালখিল্য কারণ তাঁরা মানুষের দুর্গতির জন্য মানুষকে দায়ী ঠাউরেছেন, কিন্তু রোমান্টিকশ্রেষ্ঠ বোদলেয়ার বিষাদকে স্বয়ম্ভু অহেতুসম্ভব বলে মনে করেছেন, নিহিত পাপবোধজাতজ্জআহা, বাইবেল উক্ত সেই আদিপাপ! তারপর বিষাদ থেকে বিষাদের বিলাসিতা, তা থেকে বিতৃষ্ণা এবং বিতৃষ্ণা থেকে গভীর নির্বেদ। (হাসান আজিজুল হক: বুদ্ধদেব বসু স্মারকগ্রন্থ: বাংলা গবেষণা সংসদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে যখন কবিতাচর্চা; প্রথম কাব্যে সমুপস্থিতজ্জতিনি তখন পঁচিশ বছর বয়েসী যুবক, ধারণ করেছেন পূর্ণ শহরকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগের হননকাল, জিজ্ঞাসাতাড়িত নাগরিক জীবনের ক্লেদ-অবক্ষয়কে। তবে প্রশ্ন, এসব কোত্থেকে এলো? ষাটে যেন কী এক অবক্ষয়! বিটনিক-হাংরি-স্যাড করে ধূ-ধূ খা-খা শূন্য হাহাকারে নিপতিত সব, হতাশায় ডুবে গেল জীবন, অপ্রাপ্তি-উদ্ভটত্ব পেয়ে বসলোজ্জকী হবে এর ভবিষ্যৎ! মকশো করা ছাড়া কী আছে সাহিত্যে, শূন্য-জীবনের আর কি প্রকাশ! প্রেমিক-বিপ্লবী সব তার প্রথাকে ভাঙতে চায়, নতুনের আবাহন এসেছে : ‘জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে’জ্জযেন চিরাচরিত আর বহুব্যবহৃত উক্তি। তিমিরগ্রস্ত সন্ত্রস্ত চারিদিক, আততায়ী আর বেশ্যা কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরছে রাতের রাস্তায়, হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সর্বস্ব স্মৃতিকিশোর, বিচ্ছিন্ন কপর্দকশূন্য নঞর্থক কালবেলার কেচ্ছা শোনাচ্ছে সৈনিকদল:

এইমতো জীবনের সাথে চলে কানামাছি খেলা

এবং আমাকে নিষ্কপর্দক, নিষ্ক্রিয়, নঞর্থক

করে রাখে; পৃথিবীতে নিঃশব্দে ঘনায় কালবেলা!

কিংবা,

রক্তপাতে, আর্তনাদে, হঠাৎ হত্যায় চঞ্চল কৈশোর-কাল

শেখালে মারণ-মন্ত্র আমার প্রথম পাঠ কি করে যে ভুলি,

গোলাপ-বাগান জুড়ে রক্তে-মাংসে পচেছিল একটি রাঙা বৌ

পাণ্ডাত্য কবির (ইউরো-আমেরিকান) প্রতিধ্বনি কি? তবে তা সত্ত্বেও এখানে এ কবির কণ্ঠস্বর আলাদাজ্জ‘সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠেছি নটরাজের মতো’। সুগভীর নেতিবাচক চেতনা দৃঢ়তর, উন্নিদ্র-উন্মূল-উদ্বাস্তু জীবনের রক্তপাতে প্রলুব্ধ চেতনাজ্জএক গভীর আঙ্গিকের ভেতরে আটকায়, সেটি অভিনবত্বে আকুল, শঙ্কটে ভারগ্রস্ত, উচ্ছ্রিত দুর্মর দ্বিধাহীন আত্মঘাতী বাচনিক পংক্তিমালা : 

    বাঁকা-চোরা টেলিফোন পোল, দোল খাচ্ছে ওই উঁচু

    শিখরে আসীন, উড়ে আসা বুড়োসুরো পুরোন সাইনবোর্ড

    তাল দিচ্ছে শহরের বেশুমার খড়খড়ি

    কেননা সেপাই, সান্ত্রী আর রাজস্ব আদায়কারী ছিল যারা,

    পালিয়েছে ভয়ে। [“বৃষ্টি, বৃষ্টি”]

এসবের আত্মস্থ অন্তরঙ্গতায় শহীদ কাদরী সন্দিগ্ধ। ‘নিজ দেশে আমরা বহিরাগত। একটা অনিকেত উন্মূল পৃথিবীর আত্মপরিচয়হীন বাসিন্দা। উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন, নিজের ব্যক্তিগত একাকিত্বের মধ্যে অপচিত। পণ্ডিম ইউরোপ আর আমেরিকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যসর্বস্ব, রুগ্ণ ও অবক্ষয়ী সংস্কৃতির-ধারার খুবই কাছাকাছি এ। এ কারণেই ঐসব সাহিত্যের ঘুণেধরা ও বিকারগ্রস্ত প্রবণতাগুলো এত তাড়াতাড়ি আমাদের অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিল।’ (আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ) ষাটে গোটা সমাজজীবনের পথ এ ‘নতুন আর নষ্টের’ মধ্যে উন্মুক্ত। শহীদ কাদরী এ বিনষ্টিকে উদ্যাপন করেন, জাগিয়ে তোলেন উত্তেজনা, সমস্ত নষ্ট-অপচয়-অন্ধকার যেন শিল্পিত হয়ে ওঠে। পাপ ও পতনকে পবিত্র করে তুলতে চাইলেন। সেক্ষেত্রে ‘ক্লেদজ কুসুমের’ বোদলেয়ার বা র‌্যাবো তো পরিবেষ্টিত হবেজ্জএ আর নতুন কি! “অগ্রজের উত্তর” কবিতায় তাঁর স্বীকারোক্তি:

    সভয়ে দরোজা খুলিজ্জএইভাবে দেখা পাই তারজ্জমাঝরাতে;

    জানি না কোথায় যায়, কী করে, কেমন করে দিনরাত কাটে,

    চাকুরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা

    মনে হয় ইচ্ছে করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদলে!

            না, না, তার কথা আর নয়, সেই     

    বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তোজ্জশহীদ কাদরী বাড়ি নেই। 

প্রথমকাব্যে এরূপ প্রস্তুতির পর শহীদ কাদরীর আরও বিস্তার তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমায়। আত্মভাষায়, নগরনিবাসী আখ্যানেজ্জ১৪৪ ধারা, পোস্টার, রেস্তোরাঁ, ট্যাক্সি, টাইপরাইটার, সেলুন, রেফ্রিজারেটর, রেসকোর্স, পেভমেন্ট প্রভৃতিতে এ কাব্য পূর্বের চেয়ে ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত দেশ, নব-রাষ্ট্রের প্রত্যাশা এখানে প্রদীপ্ত। অভিজ্ঞতায় পেরুনো ষাটের প্রতিরোধী আন্দোলন ও বৈশ্বিক উপাচার, গণ-অভ্যুত্থান পূর্বের নিরর্থকতা থেকে প্রত্যাবর্তিত এক নতুন ভাষা। ‘স্বাধীনতা, তোমার জরায়ু থেকে/ জন্ম নিল নিঃসঙ্গ পার্কের বেঞ্চি’, ‘চকলেট, টফি আর লজেন্সগুলো/ প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে/ কেবল তোমার উঠানে প্রিয়তমা’জ্জএরূপ অভিবাদনে অর্গল অবমুক্ত। বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিপরীতে শান্তির স্বপক্ষে, জাতিসংঘ কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের উপহাস, সামরিক বাহিনীর স্বেচ্ছাচারিতার দীর্ণতায় শহীদ কাদরী প্রিয়তমাকে অভিবাদন জানানজ্জযাবতীয় শ্রেয়ো-সান্নিধ্য; তারপরে পৌঁছান আরেক উচ্চতায় নৈঃসঙ্গ্যতায়, মর্মকাতরতায়, অন্তরঙ্গ এক সঙ্গতিশোভনরূপে। বোহেমিয়ান কবি খুঁজে ফেরেন টিয়ের মুক্তি আর উড়ন্ত পাখির শান্তি, পরিতৃপ্ত মাছের অবাধ সাঁতার। তখন শহীদ কাদরী অগ্রবর্তী টেকনিকে সমকালীন পৃথিবী আর তার বৈরী সভ্যতাকে প্রকৃতিক্ষেত্রে তুলে আনেন। তাঁর প্রেরণাদাত্রী বাংলা কবিতার (সুধীন্দ্রনাথ, অমিয়) পাশাপাশি পাণ্ডিত্যে এলিয়ট, অডেন, পাউন্ড আছেন, আর বোদলেয়ার-র‌্যাবোর প্রণোদনার বিষয়টি তো এখানে আগেই উচ্চারিত হয়েছে। এ প্রবণতায় কিছু নমুনা হাজির করা যায় :

    (ক)     রাষ্ট্র মানেই স্ট্রাইক, মহিলা বন্ধুর সঙ্গে

        এনগেজমেন্ট বাতিল

        রাষ্ট্র মানেই পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত

        ব্যর্থ সেমিনার

    (খ)     আবাল্য তোমার যে নিসর্গ ছিলো নিদারুণ নির্বিকার,

        সুরক্ষিত দুর্গের মতন, আমাদের প্রতিরোধে সে হলো সহায়,

        ব্ল্যাক আউট অমান্য করে তুমি দিগন্তে জ্বেলে দিলে

        বিদ্রোহী পূর্ণিমা। আমি সেই পূর্ণিমার আলোয় দেখেছি;

        আমরা সবাই ফিরছি আবার নিজস্ব উঠোন পার হ’য়ে

        নিজেদের ঘরে।

    (গ)     সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলো পাহারা দেবে সারাটা বৎসর

        লাল নীল সোনালী মাছজ্জ

        ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা

        ভয় নেই

        আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে

        শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন 

“একুশের স্বীকারোক্তি”, “রবীন্দ্রনাথ”, “কবিতা, অক্ষম অন্ত্র আমার” কবিতায় কবির বাঙালিচেতনা, ঐতিহ্যিক ধারা বহমান। তবে নগরের চেতনায় এক আধুনিক মাত্রা অর্জন (সেটি পূর্ণায়ত কাব্যচেতনায়) শামসুর রাহমান বা সমসাময়িক অন্যদের থেকে তিনি পৃথকজ্জকাদরীর গৃহীত শব্দের পেছনে অবসাদ-ক্ষয়-বিষাদ-বিচ্ছিন্নতা যাই থাক তীক্ষèèধীরূপে একান্ত-অন্তর্বাসী হয়ে যায় এবং তাতে মধ্যবিত্তের সমস্ত রাগ-বিরাগ বা স্বস্তি-শান্তি ইমেজে অধিষ্ঠান পায়, ফর্মে তা কখনো পরা-পরিকাঠামোও হয়ে ওঠে :

        মাথার উপরে সূর্য

        পণ্ডিমে হেলান দিয়ে বসে আছেন বাদশার মতো

        একটু পরেই রাত,

        তারপর জল     

        তারপর ঠাণ্ডা করাত দিয়ে ফালি ফালি 

        কাটবে দুজনকে।

বাংলাদেশের কবিতায় এ প্রবণতার চিত্রকল্প বা সে নির্দেশিত প্রতিবেশপৃথিবী পরের কাব্য কোথাও কোনো ক্রন্দন নেইতে শান্ত শান্তির প্রবারণারূপে মূর্তমান। ‘শালিক’, ‘খরগোশ’, ‘টিয়ে’, ‘হরিণ’ রূপকল্পে কবিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়, ইতিবাচক বোধ তাতে স্থান করে নেয়। উন্মূল, বিচ্ছিন্নতার বদলে ফিরতে চান নির্জনতায়, এতে স্থিরতার ক্ষেত্র তৈরি হয়, ব্যস্ততা থেকে স্বাভাবিকতায় ফেরার আকুতি ধ্বনিত :

        (ক)    আজ সকাল থেকে একজোড়া শালিক

        গোয়েন্দার মতো আমার 

        পেছনে পেছনে ঘুরছে  

        যেন এভিনিউ পার হয়ে নির্জন সড়কে

        পা রাখলেই আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে ঠিক!

          (খ)হরিণ হননকামী ব্যাধের মাংসল মুঠো থেকে ছুটে-যাওয়া

        বল্লমের মতো তোমরা ব্যস্ত

          (গ)সরল গ্রাম্যজন খরগোশ শিকার করে নিপুণ ফিরে আসে

        পত্নীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে, চুল্লীর লাল তাপে

        একটি নরম শিশু খরগোশের মাংস দেখে আহ্লাদে লাফায়

কাব্যটি কবি-জীবন পরিক্রমার একটি রূপ। পরিপক্ব কবিমেধাই শুধু নয় এতে পূর্ণ-রুচির লব্ধ উপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রাণী-প্রকাশে তার কূলে ফেরা, ঐতিহ্যে ফেরা; ইত্যাকার শব্দসম্ভারে তা মানবতার জয়, আশাপ্রদ ও আরও পরে শব্দহীন একাকার ঐকতান। আধুনিকতার একটি চূড়ার পৌঁছাতে সক্ষম এরূপ বার্তা।

আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-এ প্রবাস বা নির্বাসন জীবনের মেসেজ। এ কাব্যের বিষয় : মূলের টান, মৃত্যুচিন্তা, পরবাসীর স্বদেশ আকুতি। আলাপনে তিনি বিচ্ছিন্ন, এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। কবিভাষায় তা রপ্ত। রোমান্টিক প্রবণতায় ‘যে আমাকে জানিয়েছিল বিদায়’, ‘সেদিন দেখেছি তিনটে শালিক যথার্থ দার্শনিকের মতো/ গভীর পরামর্শে বসেছে তোমাদের বাড়ির উঠোনে’জ্জখুব একটা পরিবর্তন নয়, তবুও প্রেম-বিপ্লবের প্রজ্ঞাসমূহ প্রবল আন্তরিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। লেনিন-মাও-চে কিংবা সালাম-বরকত অন্তর্লীন কামনায় পুনর্গঠিত। তবে তাঁর সীমানা সীমিত, অগভীর রোমাঞ্চসম্ভূত, আত্ম-অভীপ্সাব্যঞ্জক। অদ্যকার নগরবাসীর মর্মে তিনি জনপ্রিয়, কাব্যটির ‘একা’ ও ‘স্বগতোক্তি’ কবিতা থেকে :

          (১)বাতাসে বাতাসে এখন তীব্র শীত

        ভেঙে যায় দেহ 

        পুরনো বাড়ির ভিত।

        বিপাশার তীরে জ্যোৎস্না জোয়ারে তোমাকে দেখেছি ফের,

        অথচ আখের

        গোছগাছ হ’তে এখনো অনেক দেরি,

        তবুও তো চেরি

        ফোটে অযতেœ, বেড়ে যায় ঋণ

        চক্রবৃদ্ধি হারে 

          (২) তোর বান্ধবেরা একে একে উঠে গেছে

        মসৃণ মিনারে প্রত্যেকের মূল আছে,

        শেকড়-বাকড় আছে। তুই, শুধু তুই

        তল্পিতল্পা গুটিয়ে কোথায় চললি ফের, বল

নামেই (‘একা’ ও ‘স্বগতোক্তি’) কৌশল ও প্রবণতাটুকু অনুধাবন করা যায়, বাতাসে এখন তীব্র ‘শীত’, শীত বহুবর্ণবিচ্ছুরিত, মহিমা ছড়ানো, বিষাদপূর্ণ। নেতি তবে অজর রোমান্টিক, সস্তা অযতেœর চেরি। মসৃণ মিনারে বর্ণহীন বিশেষ ব্যঞ্জনার। ষাটের এ স্পন্দনটিতে অনেকেই বিচরণ করেছেন কিন্তু শহীদ কাদরী বোধের ও সৃজনের শক্তিতে হয়েছেন আলাদা। শব্দ-আধারে তা লক্ষ্যযোগ্য।  

তীক্ষ্ণধী উইটে ও রঙ্গরসে (“আমি কিছুই কিনবো না”, “বিপরীত বিহার”, “নিসর্গের নুন” প্রভৃতি কবিতা) লক্ষ্যভেদ করতে চান। তির্যক, গদ্যপরায়ণ প্রকরণ নির্মিতি পায়; সর্বাত্মক ছড়িয়ে পড়ে তাঁর ঋজুরেখ দৃষ্টিকোণ। নগর জীবনচেতনায় নিরঙ্কুশ ও সর্বপ্লাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, শব্দকুশলী শহীদ কাদরী। আত্মজৈবনিক আচরণে কবিতার বহির্মুখী আদেশ যেন অন্তর-আবহকে প্রতিষ্ঠা দেয়। আর আধুনিক নাগরিক ক্ষেত্রটি সর্বাতিক্রমী হয়ে ওঠে, দাঁড়ায় দৃঢ়তার সঙ্গে।            

মনন ও বুদ্ধিনির্ভর শহীদ কাদরী। বর্ণনায় নয়, চিত্রকল্প-চারণে কাব্যচতুষ্টয়ের ১৪২ টি কবিতায় একটি নিরঙ্কুশ নাগরিক চেতনা উদ্যাপন করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে সবরকম শব্দই (ধেই ধেই, সেন্টের শিশি, আইডেনটিটি কার্ডহীন ডানা, টো-টো কোম্পানী) স্বতঃস্ফূর্ত কাব্যভাষা পেয়েছে। এটি আমাদের কাব্যে ব্যতিক্রম। মূলচেতনাধারায় কাদরী অটল। বায়ান্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং পরে চার দশক পর্যন্তজ্জমৃত্যুচিন্তার স্বরও নাগরিক ছন্দে বা উপমান-উপমেয়ে শিল্পস্বাতন্ত্র্য অর্জন করছে। এক্ষেত্রে তার ক্যাজুয়াল বাকরীতি পরবর্তীতে বাংলাদেশের কবিতাধারায় আর আড়ষ্ট থাকেনি। 

মন্তব্য: