শহীদ কাদরী : নিসর্গচিত্রের অসামান্য রূপকার

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

কুমার দীপ

কেবল চিত্রকরই নন, নন্দনশিল্পের সকল শাখার লোকেরাই ছবি আঁকেন। গল্পকার গল্পের মাধ্যমে, নাট্যকার নাটকের বরাত দিয়ে এবং কবি আঁকেন কবিতার পংক্তিতে। সকলেই আসলে জীবনের ছবিই অঙ্কন করেন বা করবার চেষ্টা করেন। এই ছবি আঁকবার কাজে যিনি যতো বেশি পারদর্শিতা বা অভিনবত্ব দেখাতে পারেন, তাঁকেই ততো বড়ো জীবনশিল্পী হিসেবে সম্মান জানানো হয়। তবে অন্য যে কোনো শিল্পশ্রেণি অপেক্ষা কবিতায় ছবি আঁকাই সবচাইতে অভিনব এবং আশ্চর্য অনুভূতিদায়ক। অতল গভীরতাস্পর্শীও বটে। বাংলাদেশের কবিতার এক পৌরুষদীপ্ত চরিত্র শহীদ কাদরী এরকমই অভিনব ও আশ্চর্য অনুভূতিদায়ক কিছু কাব্যছবির স্রষ্টা; যিনি শহরে থেকেও বঙ্গ-নিসর্গকে কবিতা নির্মাণের অন্যতম অনুষঙ্গ করে তুলেছেন।   

খুব তরুণ বয়সেই কবিতা লিখে শামসুর রাহমানের মতো মহান অগ্রজের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন  শহীদ কাদরী । পেয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য। আরেক অগ্রজ আলমাহমুদও তাঁকে দিয়েছিলেন বন্ধুত্বের মর্যাদা। হাসান হাফিজুর রহমানের মতো পূর্বজ কবি-সমালোচকের নিকট থেকে অল্পেই আদায় করে নিয়েছিলেন কবি সম্মান। অথচ বাংলাদেশের যে কোনো কবি, অল্পকবি কিংবা অকবির তুলনায় তাঁর কবিতা ও কাব্যসংখ্যা শোচনীয়ভাবে অল্প। কবিতার সংখ্যাগত দিক থেকে কেবল তিরিশোত্তরকালের অন্যতম প্রধান কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সাথেই তাঁর তুলনা চলে। ১৯৬৭ সালে প্রথম কাব্য উত্তরাধিকার প্রকাশের সাতবছর পর ১৯৭৪ সালে তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ; পাঁচ বছর পর তৃতীয় কাব্য কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই; এর তিন দশকেরও বেশি সময় পরে ২০০৯-এ মার্কিন প্রবাসে অবস্থানকালে প্রকাশিত হলো আমার চুম্বনগুলি পৌঁছে দাও। কাব্য প্রকাশে এমন দীর্ঘ বিরতি  যে তুলনারহিতপ্রায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

২.

কাদরীর কবিতায় ছবির যে নান্দনিক উপস্থাপন চোখে পড়ে, মানসচক্ষে অপরূপ দোলা দেয় তার অপূর্ব রূপায়ণ গ্রন্থভূক্ত প্রথম কবিতাটিই। শহরের বুকে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলে, বিদ্যুৎ চমকালে বা বজ্রপাত হলে যে চিত্র তৈরি হয় তার অনুপম উপাখ্যান। অনিন্দ্য সব উপমা-চিত্রকল্পে ঠাসা কবিতাখানিতে দেখা যায় সন্ধ্যায় সহসা সন্ত্রাসে আক্রান্ত মানুষের মতো বৃষ্টি আক্রান্ত মানুষগুলো, কবির ভাষায় ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো দৌড়াচ্ছে। এমন সময় সবাইকে ঘাবড়ে দিয়ে চমকে বিদ্যুৎ। কবির কলমে চিত্রায়িত হলো ভয়ঙ্করের নান্দনিক চিত্রকল্প, সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে / বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!  লক্ষ লেদ মেশিনের শব্দ সৃষ্টিকারী এই বজ্রের আবির্ভাব, মেঘ, জল, হাওয়া সবকিছু মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে বিপদগ্রস্থ হয় ঘর-দোর, ডানা মেলে দিতে চায় জানালা কপাট, শহরের প্রাচীন বাড়িটি যে টিরোনসিরসের মতোন নড়ে ওঠে ! আর জল ! বিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলে/বয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতো নর্দমার ফোয়ারার দিকে। বৃষ্টির জলের বয়ে চল দেখেছি আমরা, এমন মিছিলের মতো অনুভব করেছি ক’জন ? আর সেই জলে, সিগারেট টিন, ভাঙা কাঁচ, সন্ধ্যার পত্রিকা, রঙিন বেলুন…ইত্যাদি ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো !    কাদরীর কবিতায় বৃষ্টির ছবি মেলে বার বার; ভিন্ন ভিন্ন রূপে।  ভরা বর্ষায় : একজন লোক কবিতায় বৃষ্টি তার লম্বা আঙুল দিয়ে একজন লোককে হাতড়ে দেখে; তার স্বপ্নের দেয়ালে হলদে স্যাঁতসেতে চিত্র আঁকে । আর তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমার ছুরি কবিতায় দেখি, তীক্ষè ছুরির ফলার মতো চতুর্দিকে বৃষ্টি পড়ে। বৃষ্টি আছে আরও দু’চারটি কবিতায়। কিন্তু বৃষ্টি নয়, শহীদ কাদরী জ্যোৎস্নারই পাঁড় ভক্ত। তাঁর বেশ কিছু কবিতায় জ্যোৎস্নারাতের তীব্র প্রভাব রয়েছে। আছে জ্যোৎস্নালোকের অপরূপ সব চিত্রমালা। নশ্বর জ্যোৎস্নায় দেখা যায় কবি জ্যোৎস্নামুগ্ধ হয়ে চোখের বিষাদ বদলে নিয়ে, হতাশারে নিঃশব্দে বকুল তলায় বিছিয়ে রাখতে চেয়েছেন। ভেবেছেন ভবিষ্যপ্রসারী এক অনিন্দ্য চিত্রকল্পরস, 

 পরিত্যক্ত মূল্যবোধ, নতুন ফুলের কৌটোগুলো

 জ্বলজ্বলে মনির মতন সংখ্যাহীন জ্যোৎস্না ভরে নিয়ে 

 নিঃশব্দে থাকবে ফুটে মধ্য-বিশ শতকের ক্লান্ত শিল্পের দিকে চেয়ে।

জ্যোৎøার, বিশেষত বঙ্গজ্যোৎøা আর তার আধার চাঁদের সৌন্দর্য অপরূপ। এবং অপরূপ  জ্যোৎøা-চাঁদকে নিয়ে বাংলা কবিতায় লোফা-লুফিও হয়েছে অপরূপতায় অপরিমেয়। কতো কবি যে তাকে কতো ভঙ্গিতে রূপায়িত করেছেন তার কোনো পরিসংখ্যান মেলানো ভার। আধুনিক কবিতায় চাঁদ তার চিরকালের নম্ররূপ পরিত্যাগ করে কখনও কাস্তে ; কখনও আবার ঝলসানো রুটি রূপে ধরা দিয়েছেন। আরো পরে এসে আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক কর্মী কিংবা ডাগর ক্ষতের মতো চিত্রায়িত হয়েছেন। কাদরীর কলমে এই চাঁদ বাউলের একতারার মতো বেজে ওঠে; কখনও বাখানে ঝুলে থাকে জবার মতো লাল হয়ে।

প্রেম নিঃসঙ্গতা ও বিষণœতার কবিতা সমকালীন জীবন দেবতার প্রতি। এখানে উদ্দীষ্ট নারীটির অশ্রুর সাথে সখ্য ঘটেছে চাঁদের। কবি বলেছেন, এই ত’ সখ্যতা তোমার দিগন্তে গেঁথে দিল শুধু নির্বীজ কান্নার মত একফোঁটা চাঁদ। এই কবিতাতেই আবার নারীকে মাঝরাতের মন্ত্রে-তন্ত্রে ভরা চঁন্দ্রের মতন মনে হয়েছে। এছাড়া চাঁদের অনিন্দ্য অস্তিত্ব আছে বন্ধুকবি রফিক আজাদকে নিবেদিত নিসর্গেল নুন কবিতায়। চন্দ্রালোকে কবিতাখানি তো বিশল্যকরণী ছোঁয়া চাঁদের অনিবার্যতা নিয়ে। অন্যদিকে অনন্য সৌন্দর্যনির্ভর চিত্রকল্পে ভরা কবিতা নর্তকীতে চাঁদকে দেখি তরোয়ালের মতো তীক্ষè ধারালো। চাঁদকে নিয়ে অত্যন্ত রূঢ় অথচ অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্য কবিতা চন্দ্রাহত সাঙাৎ-এ শুরুতেই কবি বলেন, দ্যাখো, দ্যাখো, দ্যাখো হে সাঙাৎ / কী ইৎরামি জানে অই চাঁদ /  অপেক্ষায় কল্কে জ্বলে গ্যালো, সাঁঝ-রাত/ আইলো না উঁচু ঢিবি থেকে নেমে রূপার মোরগ। চাঁদকে এমন অপূর্ব রূপার মোরগরূপে চিত্রায়িত করার অব্যবহিত পরে পুনরায় সেই চাঁদকে যখন কবির মনে হয়, নোংরা জলে ভেসে এলে যেন পাতিহাঁস, তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না। তবে চাঁদকে নিয়ে মাঝে মধ্যে অত্যন্ত নেতিবাচক চিত্র তৈরি করলেও চাঁদের আলো তথা জ্যোৎস্নাকে নিয়ে অত্যন্ত ইতি-আপ্লুত শহীদ কাদরী। প্রবল জ্যোস্নামুগ্ধ কবি একবার দূর বাল্যকালে কবিতায় জ্যোৎস্নাকে নীরব-দূরস্থায়ী নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপেক্ষা গৃহ ও গৃহস্থালী পরিবেশেই বেশি মানানসইরূপে অনুভব করেছেন। লিখেছেন, 

 জ্যোৎস্না শুধু ধ্যানমৌন পাহাড়ের চূড়ায় কোনো 

 ত্রিশূলদেহ একাকী দরবেশ কিম্বা হিমালয়ের পাদদেশে, 

 তরাই জঙ্গলের অন্ধকারে, ডোরাকাটা বাঘের হলুদ শরীর নয়,

 বরং ছাদ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পোষমানা পায়রা যখন ওড়ে,

 তখনও জন্মায় জ্যোৎস্না : ঝরে পড়ে গৃহস্থের সরল উদ্যানে।  

দেখেছেন,

 জ্যোৎস্নার জ্বলজ্বলে লাবণ্য  

 আজীবন খুচরো পয়সার মতো পার্কে, ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে 

 ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে।

কী নান্দনিক জ্যোৎস্নাকাব্যচিত্রায়ণ !  

প্রকৃতপ্রস্তাবে, শহীদ কাদরীর কবিতায় জ্যোৎস্না সর্বপ্লাবী। ক্যাপটেনের বুটের ভেতরেও সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে; মানবশরীর থেকে বের হওয়া যে বর্জ্য, সেই পরিত্যক্ত প্রসাবও ঝলমলও করে জ্যোৎস্না মেখে!  কোথাও আবার শিশিরের টলটলে ফোঁটার ভেতর জ্যোৎস্না হয়ে ওঠে করোগেট শিট। কাদরী যখন বলেন, রাত্রে গাছের পাতায় আর ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে/ খুচরো পয়সার মতো ছড়ানো জ্যোৎস্নারাজি দেখে/ ভিক্ষুকের মতো বারবার আমিও দাঁড়িয়েছি/ হাতের রুক্ষ তালু প্রসারিত করে। তখন অনুভব করা যায় কী ব্যাপক জ্যোৎস্নাবুভূক্ষু তিনি! আর যখন বলেন, মেধার চেয়েও মেধাবী জেনেছি জ্যোৎস্নাকে; তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, জ্যোৎস্না কবির কাছে কেবল সৌন্দর্যে সীমানায় প্রষ্ফুটিত কোনো কুসুমমাত্র নয়, জ্যোৎস্নাকে কবি অন্য অনেক বস্তু বা প্রাণের প্রকৃতি স্বরূপ এবং রূপ-রহস্য আবিষ্কারের পাথেয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন।  টেলিফোনের ও প্রান্তে কোনো নারী কণ্ঠ শুনে প্রথম যৌবনে যখন কবি বলেন, কী  জ্যোৎøা কণ্ঠস্বরে ! তখন জ্যোৎস্না আর আকাশের কার্নিশে ঝুলন্ত চাঁদের আলোমাত্র থাকে না, হয়ে ওঠে একটি রোম্যান্টিক চেতনার নাম। এই চেতনা থেকেই তিনি জ্যোৎস্না কিংবা জ্যোৎস্নার আধার চাঁদকে অবলোকন করেন বিচিত্র মধুরতায়। এমনকি সুদূর মার্কিন মুলুকে থেকেও তিনি বিদিশার তীরে বসে চন্দ্রজ্যোৎস্নাকে উপভোগ করেন পরম আগ্রহ ভরে। অনুজ, অনুরক্ত কবি হাসান আল আব্দুল্লাহর সাথে কথার ফাঁকেই বলে ওঠেন, টাকা জমাচ্ছি, পূর্ণিমার ওই চাঁদটা আমি কিনবোই।  এমনকি প্রবাসে থেকে লেখা সর্বশেষ কাব্য (এখনও পর্যন্ত) আমার চুম্বনগুলো পেঁছে দাও; যেখানে তিনি মূলত দীর্ঘ প্রবাসজীবনের যন্ত্রণাকেই বড় করে দেখেছেন, মা-মাটি আর শেকড়ের টানে, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের টানে আলোড়িত হয়েছেন, সেখানেও সাদা খরগোশের মতো কম্পমান (বিব্রত সংলাপ) অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছে চাঁদ। বস্তুত, চাঁদ-জ্যোৎস্নাকে কবি যে ভুলতে পারেন নি কখনও, এসত্য তাঁর সমগ্র কবিতাপাঠেই অনিন্দ্য চিত্রময়তায় অনুভবযোগ্য করা যায়। 

আগেই বলেছি, কাদরীর চতুর্থ এবং এখনও পর্যন্ত শেষ গ্রন্থ আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও-তে প্রবাসজীবনের যন্ত্রণা, স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র আর শেকড়ের প্রতি আকর্ষণের তীব্রতা ব্যক্ত হয়েছে; তবে এগুলোর মাঝেই যে বঙ্গনিসর্গ আর বাঙালিকে দারুণভাবে উপলব্ধি করেছেন সেকথাও উল্লেখের দাবি রাখে। প্রকৃত পক্ষে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন সুদূর ফ্রান্সে বসেও সাগরদাঁড়ী আর কপোতাক্ষ নদের কথা ভুলতে পারেন নি, শহীদ কাদরীও তেমনি বিপরীত গোলার্ধের আমেরিকায় দিনাতিপাত করলেও তাঁর কবিতায় ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে শ্রাবণের রাঙা জল; আষাঢ়ের ঘন মেঘের এবং শাড়ি পরা বাংলার মায়েদের দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে তাঁর কবিতার উপর। বাংলার বর্ষণমুখর রাত্রির কালো হাওয়া যেমন অনুভব করেন মার্কিন মুলুকে বসে, তেমনি বাংলার সোনালী খড়বাহী গরুর গাড়ির মতো মন্থর গতিতে বয়ে চলে তাঁর কবিতা। বস্তুত, যত দূরেই থাকুন কাদরী, বাংলা মায়ের শাড়ির আঁচল আর বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ তাকে ছেড়ে যায় নি। পশ্চিমের প্রবল শীতেও বাংলার মমতা কবিকে উষ্ণ পোষাকের মতো আবৃত করে রাখে ; কবির হৃদয়ের ক্যানভাসে ভাসে চিরায়ত বাংলার ছবি।   

৩.

শহীদ কাদরী নাগরিক কবি। নগরজীবনই তাঁর কবিতার প্রধান উপাদান। চাঁদ-জ্যোস্না ছাড়া নিসর্গের আর কোনো উপাদানই তাই বিশেষ স্থান করে নিতে পারে নি তাঁর কবিতায়। এখানে জোনাকি আছে, তারা সোনালী জরির মতো নকশা জ্বেলে দেয়, অমাবশ্যার অন্ধকারে গোলাপঝাড়ের মতো পুঞ্জ পুঞ্জ ভরে থাকে সে জোনাকিও আবির্ভূত হয় জ্যোৎøা কিংবা অনুকিছুর অনুষঙ্গ হিসেবে ; বলা যায় জোনাকির যে একটা স্বতন্ত্র ও সৌন্দর্যময় অস্তিত্ব রয়েছে তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কাদরীর কবিতায় শর্করার মতো রাশি রাশি নক্ষত্রবিন্দুর দেখা পাওয়া যায় ; হীরার কৌটোর মতো শিশির টলটল করে ফুটপাতে শুয়ে থাকা ন্যাংটো ভিখিরির নাভিমূলে ; কবি নিজেও ওষুধের ফোঁটার মতো বিন্দু বিন্দু গলাঃধকরণ করতে চান প্রতিশ্রুতিশীল শিশির; গাছ-মাছ-জল সহ সকল গ্রাম্য আবহই দু-একবার হাজির হয়েছে তার কবিতায় ; নিসর্গকে নিপুণ জেলে বলেও ভেবেছেন কখনওবা ; নিসর্গের আকর্ষণে বারবার যেতেও চেয়েছেন গ্রামে; তবুও, নৈসর্গিক চিত্র অথবা পল্লীপ্রধান বাংলাদেশ, কোনোটাই কাদরীর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় নয়। বরং নগরের বাসিন্দা বলেই হোক আর নাগরিকতার সর্বগ্রাসীরূপের প্রভাবেই হোক, নগরজীবনই তাঁর কাব্যের প্রধান উপাদান। এমনকি তিনি যখন নৈসর্গিক কোনো উপাচারের নান্দনিক পঙক্তি উপস্থাপন করেন, তখনও নগর ও নাগরিক ভঙ্গি এবং ভাষাপ্রয়োগেও নাগরিকতা লক্ষ্য করা যায়। তারপরও, বঙ্গ প্রকৃতি আর বাংলার নিসর্গের যে ছবিগুলো তিনি আঁকেন, যে মমতায় আঁকেন তা কেবল কাব্য হিসেবেই নয় ; স্বদেশ, স্বজাতি এবং স্বনিয়ন্ত্রিত জীবনদর্শনেরও অনিন্দ্য নান্দনিকতার অসামান্য প্রতীক।     

মন্তব্য: