সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছােটগল্প : যুগযন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

তপন বাগচী

কবি সুকান্তকে যতটা দেখি, বিপ্লবী সুকান্তকে যতটা চিনি, গল্পকার সুকান্তকে ততটা জানি বলে মনে হয় না। তাঁর সাহিত্যমূল্যায়নের ক্ষেত্রে অকালপ্রয়াণের মর্মান্তিক ঘটনাকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হয়। তারপরেও বলতে পারি যে, ছড়া, কবিতা, গান, নাটক ও গল্পের ক্ষেত্রেও সুকান্তের অবদান রয়েছে অসমাপ্ত জীবনপ্রাপ্তি সত্ত্বেও। একটি উপন্যাস রচনারও চেষ্টা করেছেন। অসমাপ্ত জীবনের জন্য সেই উপন্যাসও অসমাপ্ত রয়ে গেছে।

সুকান্ত এক অস্থির সময়ের কবি-প্রতিনিধি। কবিতাকে তিনি হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছেন। কবিতার মাধ্যমে গণজাগরণের স্বপ্ন দেখেছেন। স্বাধীনতার তীব্র বাসনা ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের (১৯২৬-১৯৪৭) হরতাল গ্রন্থে ঠাঁই পাওয়া ‘হরতাল’, ‘লেজের কাহিনী’, ‘ষাঁড়-গাধা-ছাগলের কথা”, ‘দেবতাদের ভয়”, ‘রাখাল ছেলে’ প্রভৃতি কিশােরতােষ রচনাকে গল্প বলা যায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু সাহিত্যবিচারের ভাষায় এর একটা পরিচয় তাে থাকতে হবে। কোনাে না কোনাে গােত্র তার রয়েছে নিশ্চয়ই। বিশিষ্ট সুকান্ত-গবেষক অনুনয় চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘জীবনশিল্পী সুকান্ত (পপুলার লাইব্রেরি, কলকাতা, ২য় সং, ১৯৮১, পৃ. ১৮২) গ্রন্থে এই ‘গল্পগুলােকে গল্প না বলে শিশুকাহিনী বলাই সঙ্গত বলে অভিমত দিয়েছেন। সুকান্ত সমগ্র গ্রন্থে গল্পগুলােকে ‘অপ্রচলিত রচনা নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘অরণি পত্রিকার মাধ্যমেই গল্পভুবনে পদার্পণ করেন। অপূর্ণ জীবনে তিনি মাত্র ৫টি পূর্ণ গল্প রচনা করেন, তার ৩টিই ছাপা হয় এই পত্রিকায়। অন্য দুটি ছাপা হয় ‘জনযুদ্ধ পত্রিকার কিশাের বিভাগে। সুকান্তের গল্পকার সত্তা নির্মাণে অরণি ও জনযুদ্ধ পত্রিকার ভূমিকাকে গুরুত্ব দিতে হয়। ‘হরতাল’ গ্রন্থের বাইরে থাকা সুকান্তের পাঁচটি গল্পের প্রকাশতথ্য নিম্নরূপ:

ক্ৰমগল্পের নামপত্রিকার নামপ্রকাশকাল
১.ক্ষুধাঅরণি২ এপ্রিল ১৯৪৩
২.দরদী কিশোরজনযুদ্ধ২৮ এপ্রিল ১৯৪৩
৩.দুর্বোধ্যঅরণি২৮ মে ১৯৪৩
৪.কিশোরের স্বপ্নজনযুদ্ধ৬ অক্টোবর ১৯৪৩
৫.ভদ্রলোকঅরণি১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭

একথা ঠিক যে সুকান্ত’র কবি-পরিচয়টাই মুখ্য। তবু সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমে তিনি সৃজনশীলতার ছাপ রেখেছেন। সুকান্তপ্রতিভার সামগ্রিক মূল্যায়ন এই সকল ‘গৌণ ক্ষেত্রকেও এড়িয়ে যাওয়ার সুযােগ নেই। এই গল্পগুলাে ছাড়াও বেশ কিছু অসম্পূর্ণ গল্প রয়েছে সুকান্তের লেখার মধ্যে এমন তথ্য জানিয়ে একটি গল্পের অংশবিশেষ তুলে ধরেছেন সুকান্তের বন্ধু অরুণাচল বসু কবিকিশাের সুকান্ত (সরলা বসু সহযােগে রচিত গ্রন্থ, সারস্বত লাইব্রেরি, কলকাতা, ২য় সং, ১৯৬৯, পৃ. ৪৬)। উক্ত গ্রন্থে উদ্ধৃত গল্পাংশে সুকান্তের ‘সৌন্দর্যমুদ্ধ স্বপ্নময় মনটি’র সন্ধান পেয়েছিলেন অরুণাচল বসু। কিন্তু আমরা তাঁর উপর্যুক্ত ৫টি গল্পের বিশ্লেষণে ক্ষুধা-দারিদ্রযের ছবি অংকনে পারদর্শী অন্য এক সুকান্তকে দেখতে পাই।

ক্ষুধা গল্পটি মস্তরের প্রেক্ষাপটে বস্তিবাসী জীবনের গল্প। নীলু ঘােষ নামের প্রেসের কম্পােজিটার আর হারু ঘােষ নামের চটকল শ্রমিকের গল্প। দুজনেই স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী। চাকরি হারিয়ে দুজনেই সংকটে। দুর্ভিক্ষে দু’জনেরই আত্মহনন। বস্তির সকলে দেখে, ‘হারু ঘােষ বারন্দায় আর নীলু ঘােষ ঘরে দারিদ্র্য ও বুভুক্ষাকে চিরকবালের মতাে ব্যঙ্গ করে বীভৎসভাবে ঝুলছে, যেন জিভ ভেঙাচ্ছে আসন্ন দুর্ভিক্ষকে। কিন্তু বস্তির মানুষ শােক করতেও ভুলে যায়। সকাল হলেই তারা কন্ট্রোলের দোকানে ভিড় জমাতে ছুটে যায়। দুর্ভিক্ষের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলতে গল্পকার এখানে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পকার বলেছেন, ‘অদ্ভুত ক্ষুধার মাহাত্ম্য! বিনয় ভাবতে থাকল ক্ষুধা শােক মানে না, প্রেম মানে না, মানে না পৃথিবীর যে কোনাে বিপর্যয়, সে আদিম সে অনশ্বর। ক্ষুধার স্বরূপ উন্মােচন করে লেখা এই গল্পটি সুকান্তের একটি উল্লেখযােগ্য সৃষ্টি।

‘দরদী কিশাের’ গল্পটি সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়ােজিত করার কাহিনী। স্বচ্ছল পরিবারের এক কিশাের ঘরের জানালা দিয়ে দেখে কন্ট্রোলের দোকানে দরিদ্র মানুষের ভিড়, চালের জন্য বিশাল লাইন, মারামারি। চাল না পেয়ে ফেরা মানুষগুলাের মলিন মুখ দেখে তার বুকের ভেতর হাহাকার জমা হয়। কিন্তু আভিজাত্য ও পারিবারিক গণ্ডি ভেঙে সে বাইরে আসতে সাহস পায় না। একসময় সে গােপনে গঠন করে কিশাের স্বেচ্ছাসেবক দল। তারপর নিজেদের ঘরে রাখা ষাট মণ চাল বিলিয়ে দেয় বস্তির অভূক্ত মানুষের মধ্যে। জানতে পেরে বাবা তাকে প্রহার করে ঘরের ভেতর আটকে রাখে। কিন্তু তাতেও তার মন ভেঙে পড়ে না। সে যখন দেখতে পায় বস্তির গরিব মানুষগুলাের চুলােতে ধোঁয়া উড়ছে। তাঁর দেয়া চাল থেকে ভাত ফুটবে। সেই ভাত খেতে পাবে নিরন্ন মানুষ। এই ভেবে

কিশােরের বুক ভরে যায় আনন্দে। এভাবে শতদ্রু নামের এক কিশাের হয়ে ওঠে দরদী কিশাের। অত্যন্ত প্রেরণাসঞ্চারী বক্তব্য রয়েছে এই গল্পে। 

একজন অন্ধ ভিক্ষুকের সমাজচেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কাহিনী বিধৃত হয়েছে “দুর্বোধ্য’ গল্পে। দুর্ভিক্ষতাড়িত দেশে রেলস্টেশনমুখী পথের পাশে এক তেঁতুলগাছের ছায়ায় প্রতিদিন বসে ভিক্ষা করে। তাঁর বিশ্ব ওই তেঁতুলগাছের তলা। বিশ্বের রাজনীতি আর কলকাতার দুর্ভিক্ষের খবর তার জানা নেই। সারা দেশের মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় কাতর। ক্ষুধার তাড়নায় মানুষ মারা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের দাবি ‘অন্ন চাই।’ ভিন্ষুকের দাবি ‘ভিক্ষা চাই।’ নিরন্ন মানুষের মিছিলে সে-ও সামিল হয়, শ্লোগানে কণ্ঠ মেলায়। একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক ছবি আঁকা হয়েছে এই গল্পে ।

 “কিশােরের স্বপ্ন’ গল্পটি প্রতীকের আড়ালে মাতৃসম স্বদেশের দুর্গতি জয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে। ব্রিটিশের অপশাসনের বিরুদ্ধে, মানুষের দুর্গতি মােচনের সংগ্রামে মানুষকে সচেতন করার স্বপ্ন দেখছে এই কিশাের। জনগণের ঐক্যবদ্ধ হওয়া, দেশের জন্য মাঠে নেমে কাজ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার স্বাধ এনে দেওয়ার স্বপ্ন দেখা ও দেখানাের গল্প বলেছেন লেখক। কিশােরের মায়ের উপলব্ধি, ‘আমার কিষাণ ছেলেরা আমার মুখে দু’টি অন্ন দেবার জন্যে দিনরাত কী পরিশ্রমই না করছে; আর মজুর ছেলেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আমার কাপড় যােগাবার জন্যে। অধিকার প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন আকাঙজাই এ গল্পের মূল সুর। পাঠকের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য এটি উৎকৃষ্ট রচনা।

‘ভদ্রলােক’ গল্পটি সুকান্তের শেষ গল্প। এটি শ্রেণিচেতনার গল্প। শ্রেণিচ্যুত হওয়ার গল্প। ভদ্রলােক থেকে ছােটলােক হওয়ার গৌরবের গল্প। বাসযাত্রী থেকে সুরেনের বাস-কণ্ডাক্টর হওয়ার গল্প। কিন্তু এটি সমাজবদলের আকাঙ্কষায় ঘটেনি। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার হতাশা থেকে হয়েছে। তবু লেখার গুণে গল্পটি উপভোগ্য।

সুকান্তের গল্পকার সত্তার পরিচয় যেমন পেয়েছেন তাঁর বন্ধু অরুণাচল বসু, তেমনি তাঁর গল্পের ক্ষমতার কথা বলেছেন বাংলা কথাসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ এক কারিগর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ‘তরুণ লেখকের’ গল্প সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘ছােটগল্পে ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে তরুণ লেখককে প্রশংসা করেছি, উৎসাহ দিয়েছি। সুকান্তকে কবিতার প্রশংসা শােনানাের সম্পর্কে সতর্ক ছিলাম। কাব্যসমালেচনার সঠিক পদ্ধতি আমার জানা নেই,বিচার বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে খানিকটা হাওয়ার তারিফ শােনাতে ইচ্ছে হতাে না। তাছাড়া নিজে

থেকে সে যে কঠিন সংগ্রাম গ্রহণ করেছিল, তাতে তাকে উৎসাহ দেবার প্রয়ােজনও ছিল না কিছুমাত্র। (কবিও পেয়ে গেছে নতুন যুগ, স্বাধীনতা, ১৮মে ১৯৪৭, উদ্ধৃতি: অনুনয় চট্টোপাধ্যায়, জীবনশিল্পী সুকান্ত, পৃ. ১৭৩)। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাে সাহিত্যিকের কলম থেকে এটুকু স্বীকৃতিই যথেষ্ট একজন গল্পকারের জন্য। সুকান্ত সেই স্বীকৃতি অর্জন করেন গল্পকার হিসেবেই।

সুকান্ত যে সময়ের প্রতিনিধি, সে সময়ের কথাই ফুটিয়ে তােলার চেষ্টা করেছেন তার গল্পে। ব্রিটিশ-শাসন, ক্ষুধা-মম্বন্তর, পরাধীনতার শােষণ সেই সময়ের জনজীবনকে দুর্বিষহ করেতুলেছিল। বিশ্বজুড়ে বিরাজিত ফ্যাসিবাদের সেই ভয়াবহ দিনগুলােতে সুকান্ত ট্টচর্য রাজনীতির পাশাপাশি সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হন। মাত্র একুশ বছরের কিশাের দেশের কথা বলেছেন, দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন কবিতায়, নাটকে, গানে ও গল্পে। একটি যুগের যন্ত্রণার ছবি এঁকেছেন তিনি পরম মমতায়। তাঁরই শিল্পভাষ্য সুকান্তের ছােটগল্প। তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকীর্তির পাশাপাশি ছােটগল্পের দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া যেতে পারে। যুগযন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ধারণ করা তাঁর এই ছােটগল্পগুলাে বাংলা ছােটগল্পের বিশ্বে এক অমুল সম্পদ।

মন্তব্য: