নবগঙ্গা ও তার মাঝিদের অল্প সল্প গল্প

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এম মনির উজ-জামান

মুন্সী পাড়া থেকে সোজা পুর্বাশা ঘাটে যেতে যেতে সওয়ারির একজন 

এইযে কবির —-

তা তোমার আয় রোজগার কেমন? কবির মাঝি একটু অপ্রস্তুত হয়েই—এই আপনার দিনে ত্রিশ/চল্লিশেক। বেশি হলে পঞ্চাশ। এতে কি সংসার চলে। তা কয়জন তোমার পুষ্যি? চলে যায় কোনো রকম। কবির মনে মনে ভাবে সংসার চলে না বললেই কি আর আয় রোজগার বেড়েছে কোনো দিন। কেন রে বিয়ে করিস নি বুঝি ? কবির হেসে উত্তর দেয় কই নাতো! কবির অল্প শিক্ষিত হলেও জানে, বিপদে পড়লে মাঝিদের প্রতি যাত্রীদের তাচ্ছিল্যের ভাব খানিকটা সমীহে পরিণত হয়। কথাগুলো শুনতে ভাল। কিন্তু কোন কাজের কথা নয়। অনেকটা মিঠে কাঁচা আলাপ আর কী। তাই ছাতাটা এগিয়ে দেয় সবকিছু বুঝেও;  না বুঝার ভান করে। আরে তুই ভিজে যাবি যে। কবির কোমর থেকে গামছা খুলে মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বলে— এইতো আমার এতেই চলবে। সন্ধ্যা প্রায় নেমে আসে। আঁধারের চাদরে ঢাকা পড়ে শ্যামল সবুজ জনপদ। মানুষ তার আপন আপন রূপে ফিরে যেতে থাকে। 

কবির দু’জন যাত্রী নিয়েই টুপটাপ বৃষ্টির মধ্যে ওপারের পথে নৌকা ছাড়ে। কখন যেন আনমনা হয়ে যায়। হারিয়ে যায় স্মৃতির অরণ্য তলে। আর এভাবেই কবিরের আপন ভূবনে। গরীব ঘরে জন্ম তার। সংসার বলতে কবির তার মা আর বাবা-মানে বৃদ্ধ খেয়া মাঝি। সবেমাত্র কৈশোরের শেষ সিড়িটা অতিক্রম করে যৌবনের রাজ সভায় প্রবেশ করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় ভিঙ্গিয়ে হাই স্কুলে লেখাপড়া করছে। ক্লাস এইটের বীজ গণিতের সূত্র পড়তে পড়তে কখন ঘুম সাগরে তলিয়ে যায়। মুন্সী বাড়ির ছেলে; হারুনের ডাকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায়। কবির; এই কবির! কবির শোন! মদ্যি গাঙ্গে তোর বাপের নৌকা ডুবে গেছে। তোর বাপের কোনো হদিস নেই রে। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিকের জন্য বেশামাল হয়ে গেল। হঠাৎ যেন কবিরের পৃথিবী দুলে উঠতে চাইল। ভৌতিক হয়ে উঠল হারুনের ডাকটা। কবির! কবির! কবির! তোর বাপের নৌকো ডুবে গেছে! ডুবে গেছে!! ডুবে গেছে!! ডুবে গেছে!! এক বিশেষ ঋতুতেই কাল বৈশাখীর ঝড় ওঠে। কিন্তু কবিরদের জীবনের ঝড়-কাল বৈশাখীর কোন ঋতুর বালাই নেই। গভীর রাত চারিদিক অন্ধকারের ডালপালা ছড়িয়ে আছে। কোথাও পেঁচাটা তার আপন স্বরে দূরগুম-দূরগুম ডাকতে থাকে। কবির কিছু না ভেবেই অন্ধকার গায় মেখে ভোঁ দৌড়। পিছু তার নিরুপায় মা। তার বাপকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পাওয়া গেল। তারপর আজীবন অসুস্থ। সেই তারপর সঙ্গত কারণেই সংসারের ঘানি তার ওপর এসে পড়ল। বেজে উঠল অশনি সংকেত। 

বৃদ্ধ মাঝির ছেলে, কবির মাঝি। লেখাপড়া ইতি টেনে এক দুঃসহ যন্ত্রণার কাছে সেই দিন ধরে জিম্মি হয়ে আছে। আকম্মিক এ ঘটনায় বাড়ির সবচেয়ে উজ্জ্বল আর নির্ভরযোগ্য তারাটি স্নান হয়ে গেল। আর স্বপ্নগুলো তখন হাওয়ায় মেললো ডানা। এই কাল অধ্যায় সে আর কখনও অতিক্রম করতে পারেনি। অনাগত জীবনের সুস্থতা এবং নিরাপত্তা বোধ ভেঙ্গে চৌচির তখন। ওতো কবিরের বাবার নৌকা ডুবি নয়। ও হচ্ছে কবিরের আশা- আকাঙ্খা ও স্বপ্নের হারিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র মাত্র।

গরীব ঘরে জন্ম নিলেও সংসারটা ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। তারপর অংকের সূত্র মুখস্থ করতে করতে ঘুমের দেশ থেকে স্বপ্নের রাজ্যে চলে যাওয়া। তারপর হারুনের ডাকে নৌকা ডুবির খবর। তারপর দূরে কোথাও দূরগুম দূরগুম করে পেঁচার ডাক। তারপর বাবার আজীবন অসুস্থতা। সেই তারপর—–। মৌখিক সহানভূতি সবাই দেখিয়েছিল। কিন্তু তখন কবিরের পথে বসবার অবস্থা। পরের দিন কি খাবে সে সংস্থানই নেই। কেউ সে কথা একবার মুখ ফুটেও বললো না। যে সস্তা মায়া দয়ার কোনো মানে হয় না। যে মায়া দয়া সংকট ক্রাণের ভূমিকা নেয় না সেই মায়া দয়া মানুষের কাছে মূল্যহীন। কবির মনের অজান্তেই গেয়ে ওঠে কেমনে ও গঙ্গা হব পার-আমি জানিনে সাঁতার। 

দায়-দায়িত্বহীন জীবন। স্কুলের লেখাপড়া আর প্রয়োজনে বাজারে যাওয়া আর ঘাটে বাবার খাবার নিয়ে যাওয়া-আসা; এইতো ছিল কাজের মধ্যে কাজ। আনন্দে বাতাস সাঁতরে শুধু চলা। এখন তা স্মৃতি এবং পরবতী প্রতিক্ষা মাত্র। ভাদ্দরের এটেল মাটি চৈত্রের রুক্ষতায় যেমন কঠিন হয়ে যায়- কবির তেমনি পাল্টে গেল। এ যেন শিউলী-চাঁপার মত পূর্ণ যৌবনে ঝরে পড়া। এতো বেঁচে থাকা নয়- মরচে পড়ে পড়ে শেষ হয়ে যাওয়াই শুধু। 

অন্যান্য মানুষের সুখ-দুঃখের হাওয়ায় কবির ভেসে চলেছে। আজ নিজের সুখ-দুঃখের কথা ভাববার অবকাশ নেই। এইতো গত বছর বর্ষা মৌসুমে নৌকা স্থলে ভিড়বে ভিড়বে মুহূর্তে পাড় ভেঙ্গে মাটির চাঁই এসে নৌকার এক পাশে পড়ায় নৌকা পাড়ে আসার মুহ‚র্তে পাড় ভেঙ্গে ডুবে গেল। অনেক ছেলেমেয়ে লাফ দিয়ে কূলে উঠতে পেরে সেকি হাসাহাসি-আনন্দ উল্লাস। আবার একজন মহিলার বাচ্চা পানিতে পরে যাওয়ায় তার কান্না দেখার মত। কিন্তু কবিরের হাসলেও চলে না আবার কাঁদলেও চলে না। তার যে অনেক অলিখিত দায়িত্ব বোধ বিবেকের কাঁটার মত। আঁধারের নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে একদিন ডেকেছিল দুরগুম দূরগুম সুরে এক পাখি। আধাঁরে ফুটে উঠেছিল মানুষের আসল রূপ। কবির পানিতে ঝাপিয়ে বাচ্চাটাকে তুলে নিল। তারপর যে যার দিকে রওনা হল। কবির পেছন থেকে পয়সা ! একজন মহিলা হেসে বললো এখন খুচরো নেই। যেন হেসেই কবিরদের ঋণ শোধ করা যায়। এতেই যেন মহাপ্রাপ্তি এমনই মনে হয় তাদের কাছে। সবাই এখন ভুলে গ্যাছে, মানুষের পেশা দিয়ে মানুষের যোগ্যতার বিচার হয় না, কস্মিনকালেও হয়নি। হতে পারে না। কবির একজন মাঝি তাই তার প্রতি এই অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য। অথচ মাটির বেড়ালই হোক আর কাঠের বিড়ালই হোক ইদুর ধরতে পারাইতো আসল। এইতো মাঝে মাঝে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হলেই। মা এসে-কবির; এই কবির বাজান ওঠ। কবির আড়মোড়া ভাঙ্গে। যা বাজান-মানসির খেদমত কর; উপকার আসবিনে তোর। মায়ের কথা সে অমান্য করেনি। মা অশিক্ষিত কিন্তু মার স্নেহ সত্যি উদার অনন্ত মহাকাশ মহাসমুদ্র-সন্তানের জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে সে মাতৃ স্নেহের ঠিকানা পাওয়া অসম্ভব কিছু! তাই মায়ের কথা অমান্য করেনি। কিন্তু কই! আজও কেউ তার উপকারে আসলো না!!  কেউ ভুলেও জানতে চায়নি কবির কেমন আছে ? ভাল আছো তো? যখন কবির এ সব ভাবে এত বড় পৃথিবীতে তার একজনও শুভাকাঙ্খি নেই; তখন বুকের ভেতর কেমন শিরশির করে ওঠে। শরতের সুন্দর শিউলি ফোঁটা গর্বিত সকাল অমাবশ্যার রাততির হয়ে যায়। তাই তো কবির অন্য কৌশল ধরে, কিরে পিন্টু; বাদাম বেচে তোর দিন চলে ? না চললি কী করবো কবির ভাই ? তোর মাথায় চুল গুলো তো খুব ভালরে তা কী সাবান দিস মাথায় ? কি সাবান দেব আবার মানসি যা দেয় আমিও তাই দেই। যার ভালহয়; তার এমনিতেই হয়। পিন্টু পারানি হিসেবে আট আনা পয়সা কবিরের কাছে দিতে গেলে; নারে তোরি আর কয় টাকা হয়? নে রেখে দে! কাজে দিবেনে তোর। আসলে আট আনা ফেরত দেওয়া নয়; যেন নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা। যা কবির হয়নি ; যা কবির হতে পারেনি তাই হওয়া ; আট আনার প্রত্যেক পাইয়ের সাথে যেন নিজেকে গড়ে তুললো। গড়তে চেষ্টা করলো। একটা ভীষন ভাল লাগা মেশান প্রতিহিংসা সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠা করল। 

তারপর যতবার পিন্টুর সাথে দেখা হয়েছে। কেমন আছেন; কবির ভাই? এইত ভালই আছি। আপনার মা কেমন? হ্যাঁ ভাল। তোর যে কয়েক দিন দেখলাম না, ব্যাপার কী? জ্বর হইছিল কবির ভাই। আজ একটু সুস্থ তাই মনে করলাম যাই দ্যাহি কিছু হয় নাহী? 

কবির অসুস্থ্যের ভান করে ১/২ দিন মাঝির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়; ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। এতে অনেকে তার বাড়ীতে হানা দেয়; এই কবির; ওপারে যাবিনে ভাই ? তা নাহলে যে আমাদের ঘুর পথে ব্রীজ পার হয়ে শহরে যেতে হবেনে নে চল যাই। কবির জানে, এতে তার কোন লাভ নেই বা হবে না। তার-এ-সমাজের ওপর যে ক্ষোভ ঘৃনা জমা আছে সে জন্যই সমাজকে শিক্ষা দিতে চায়। তোমরা যে চক চক আয়নায় মুখ দেখ- সে অংশ আসল নয়। আসল হচ্ছে সে আয়নার পিছনে যে ময়লার মত পারা থাকে সেটাই। সেটা না থাকলে মুখ আর দেখা যায় না। হা-হা-হা। 

পৃথিবীতে যত সম্পদই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকুক না কেন যোগ্যতা ছাড়া একান্ত নিজস্ব কোন সম্পদ মানুষের আর নেই। 

তোমরা যারা গর্বিত পোশাক পরিচ্ছেদ পরে ঘুরে বেড়াও এসমাজে উন্নয়ন ধারায় তোমাদের চেয়ে শ্রমজীবি মানুষের অবদান অনেক-অনেক বেশী। যাদের ঘামের গন্ধে নাক সিঁট কাও। ঝঞ্জাল বলে যাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাও। তাই ইচ্ছে করেই কবির শুয়ে থাকে। এ সমাজে একজন কবির না থাকলে শত শত মানুষের কত কষ্ট হয় তাই যেন শিক্ষা দিতে চায়। তুরূপের অনেক গুলো তাস যেন কবিরের হাতে ? ধীরে সুস্থে কি ভাবে খেলবে এখন সেই হিসেব- সেই বিবেচনা। এতদিন শুধু দৈন্য দেখেছ এবার আমার ঐশ্বর্য টুকুও দেখ। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নৌকো কূলে এসে ঠেকল। কুলে এসে নৌকো ভিড়তেই নে কবির; তোর ছাতাটা নে। এক টাকা দিয়ে নেমে পড়ে তারা দু’জন। 

ঈশান কোনে মেঘ। বাতাসে তান্ডব? ঢেউ ছলাৎ; ছলাৎ; শব্দ তোলে। কেউ একজন ওপার থেকে; এ কবির নিয়ে যা বৃষ্টিতে ভিজে গেলাম। কবির পিছন ফিরে নেমে যাওয়া যাত্রীর উদ্দেশ্যে তাকিয়ে দেখে তাদের ছাঁয়াও আর দেখা যাচ্ছে না। কারণ তাদের যে কাজ তা শেষ হয়ে গ্যাছে একটু আগেই। এখন কবিরের দিন চলে কী চলে না তা ভাবার সময় কই! পৃথিবীতে কবিরের কথা ভাববার আর কেহ নেই। বৃষ্টি-ঝড় বাতাস আর নদীর ঢেউ সব কিছু উপেক্ষা করে কিংবা সব কিছুকে সাথে করে কবির ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কবির জানে না; এই ঝড়ো হাওয়া ওপারে পৌছতে দেবে কিনা। কথায় আছে নদীর ধারে বাস ভাবনা বার মাস আর এ-তো খোদ নদীর ওপর বাস। তবু তার যে বড় দায়িত্ব তাই তার যেতে হবেই। কবির দাঁত কিট-মিট করে নেমে যাওয়া সওয়ারির উদ্দেশ্যে বলে, ইচ্ছে করে পিন্টুর মত অমন আট-আনা করে দেশের সব মানুষ কিনে ফেলি। অন্ধকার ছাপিয়ে তার বাবার মুখ ভেসে ওঠে। একমুঠো কুলে ফেরার স্বপ্ন নিয়েই সাঁতার কাটতে থাকে কবির। তার সেই চিরচেনা পাখিটা আপন স্বরে ডাকতে থাকে। ডাকতে থাকে।।

মন্তব্য: