মাজহারুল হক লিপু
আমার বন্ধু অরূণ সান্যাল বেশ কয়েকদিন ধরে আমার পিছনে লেগেছে ওদের একটা লিটল ম্যাগ বের হবে তাই একটা গল্পের জন্য। অরূণ খুব ভালাে একজন কবি। প্রচুর ভাবতে পারে তাই প্রচুর কবিতাও লিখতে পারে। আমি বছরে দুই একটা গল্প লিখি তাও অরুণের মত কোন বন্ধুর চাপে পড়ে। সত্যি কথা বলতে কি এমনিতেই আমি একটু অলস প্রকৃতির মানুষ। তার উপর কিছু লিখতে গেলে কয়েক লাইন লেখার পর মনে হয় কিছুই হচ্ছেনা। যেটুকু লেখা হলাে সেটুকু ডিলিট করে আবার নতুন করে লিখতে থাকি। যখন দেখি এবার আর না লিখে উপায় নেই অর্থাৎ বন্ধু ছাড়ছেনা তখন রাত জেগে যা হয় একটা সমাপ্তি টানতেই হয়। অরূণকেও বেশ কিছুদিন ঘুরিয়েছি দিচ্ছি দিচ্ছি বলে। শুধু আমাকে ভালােবাসে তাই এখনাে বিরক্ত হয়নি। আমার মনে হয় আমার মত সৌখিন সাহিত্যিকের পিছনে না ঘুরে সে যদি সুনিল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে এরকম চাপাচাপি করতাে তাহলে
এতদিনে সহজেই লেখা পেয়ে যেত হাতে। যাই হােক, লেখা আমি দিচ্ছিনা সেটি আমার দোষ বলাটাও ঠিক হবে না। আসলে গল্পের প্লট খুঁজে পাচ্ছি না।
অরুণ যেদিন প্রথম আমাকে লিখতে বলল সেদিন বিকালেই আমি একটা প্লট পেয়ে গিয়েছিলাম। চৌরঙ্গী
দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম ক্ষমতাসীন দলের কয়েকটা ছেলে বিরােধী দলের এক ছাত্রনেতাকে মাটিতে ফেলে নির্মমভাবে পেটাচ্ছে। সাথেসাথেই গল্পের শাখা প্রশাখা বের করতে লাগলাম মনে মনে। রাতে কম্পিউটারে বসে লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে হলাে- না থাক। এটাতাে খুবই সহজাত ঘটনা। কয়েক বছর পর যে ছেলেটা মার
খাচ্ছিল সে নিজে থাকবে ক্ষমতাসীন দলে এবং ঠিক এভাবেই মারবে কোন বিরােধী দলের ছেলেকে। হয়তাে গত সরকারে ওরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখনাে সে মেরেছে বিরােধী দলের ছেলেদের। কম্পিউটারে ব্যাকস্পেস চাপ দিয়ে মুছে ফেললাম যেটুকু লিখেছিলাম। এরপর দুই একদিন অরূণ আর ফোন দেয়নি। অতএব বেশ নির্ভাবনায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কিন্তু পরদিনই আবার ফোন- ‘কদ্দুর এগােলে?’ আমি শুধু হাসি দিয়ে বললাম- অনেক খানি।
পরদিন ভাবনা শুরু করলাম একটা প্রেমের গল্প লিখব। বেশ কয়েক লাইন লিখেও ফেললাম। ভাবছিলাম কিভাবে শেষ করব। যতই ভাবি মনে হয় এরকম গল্পতাে কতই আছে। ব্যাকস্পেসে হাত দিয়েও ভাবলাম না আরেকটু চিন্তা করি বাকিটুকু কাল রাতে লিখব। ভাবতে ভাবতে প্রতিদিনের মত অভ্যাসবশত ঢুকে পড়লাম ফেইসবুকে। দেখে নিলাম চ্যাটলিষ্টে অরুণের নাম আছে কিনা। নেই দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। অনন্ত প্রেমিক নামে কেউ একজন স্ট্যাটাস লিখেছে ইংরেজি অক্ষরে- ‘ঘুমাতে যাচ্ছি’। হাসি লাগে দেখে। নিশ্চয় কোন টিনেজার হবে। আমার ফ্রেগুলিষ্টে কিভাবে ঢুকলাে কে জানে। সারাদিন কি করে তা বােধহয় সবাইকে জানানাই এর কাজ। হয়ত সকালে উঠেই লিখবে- ঘুম থেকে উঠলাম, বাথরুমে যাচ্ছি, … করছি। কম্পিউটার বন্ধ করে সােজা বিছানায় চলে গেলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই নবগঙ্গা নদীর ধারে। ব্রীজের রেলিঙের উপর বসে থাকি আর তাকিয়ে থাকি নদীর দিকে। এখানে প্রায়ই বসা হয় আমার। একটু বসে থাকলেই বন্ধুদের কারাে সাথে দেখা হবেই। কেউ না কেউ আসবেই একবার এদিকে। একটু পরেই চলে এল আমার অনুজ বন্ধু মহসিন। অন্ধকারের মধ্যে আমাকে খুঁজে বের করে নিয়ে পাশে এসে বসলাে। কথা শুরু করতে না করতেই আরেক বন্ধু ওবায়েদ ভাই এসে হাজির। আমি চুপ থাকলেও ওরা দুজন কথা বলতে শুরু করে। ততক্ষণে আকাশে একাদশী চাঁদ উকি দিতে শুরু করেছে। আমি পানির উপর চাদের আলাের চমৎকার বিচ্ছুরণ দেখব বলে তাকিয়ে আছি নদীর দিকে। খেয়াল করিনি কখন দু’জনের আলাপ বাংলাদেশের রাজনীতির মধ্যে ঢুকে গেছে। সেখান থেকে ডঃ ইউনুস প্রসঙ্গ। তারপর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। একসময় লাফ দিয়ে নেমে পড়ল ওবায়েদ ভাই। আমার দিকে আঙুল তুলে বােঝানাের চেষ্টা করলাে যে, আমার প্রশ্রয়েই নাকি জুনিয়র ছেলেরা বড় ভাইদেরকে এরকম
অসম্মান করা শুরু করেছে। ওবায়েদ ভাই চলে যেতেই মহসিনও উঠে পড়ে। তারও অভিযােগ আমি কিছু বলিনা তাই ওবায়েদ ভাই সবসময় বাড়াবাড়ি করে। মহসিনও উঠে চলে যায়। আমি জানি কাল বা পরও আবার আসবে ওরা। নতুন কোন প্রসঙ্গ নিয়ে শুরু করবে বিতর্ক। তখন চাঁদের আলাে তীব্র হতে গুরু করেছে। কিন্তু আমার আর বসে থাকতে ইচ্ছা করেনা তাই উঠে রওনা দিই বাড়ির দিকে।
বাসার দরজার বাইরে থেকেই গানের আওয়াজ পাই। বুঝতে পারি শহীদুল এসেছে। একটু অবাক হই। গতকাল যার বাবাকে দেখে এলাম হাসপাতালের বেডে সে কিভাবে গান গাইছে তাই ভাবতে থাকি। ও যদি ওর বাবার সত্যিকারের অবস্থা জানতে পারে তখন ওর প্রতিক্রিয়া কি হবে সে চিন্তাও খেলা করে আমার মধ্যে। শহীদুলের বাবা সামান্য মােটর মেকানিক। পাঁচ ভাইবােনের মধ্যে শহীদুলই বড়। এসএসসির পর পড়াশুনা হয়নি। একটা প্রাইভেট অফিসে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করে। মাঝেমধ্যেই আমার বাসায় আসে। আমার স্ত্রী শামীমা কেন জানি ওকে খুব স্নেহ করে। গতকাল আমি আর শামীমাহাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে জেনেছি শহীদুলের বাবাকে নিয়ে তাদের আর কোন ভরসা নেই। আমি বলেছিলাম, যদি ঢাকায় নেয়া হয়? ডাক্তার বললেন, দেখতে পারেন তবে টাকা খরচ ছাড়া কোন লাভ হবেনা। সত্যিই তাই। এমনিতেই অভাবের সংসার ওদের। অযথা টাকা খরচ করে লাভ কি? ডাক্তারকে অনুরােধ করলাম ওদেরকে কিছু না বলতে। ভাবলাম টাকার অভাবে চিকিৎসা হয়নি এরকমটি ভেবে হয়ত সারা জীবন কষ্ট পাবে ওরা।
নক করতেই দরজা খুলে দিল শামীমা। গান বন্ধ করে শহীদুল বেশ আবেগের সাথেই বলল, ভাইজান, আব্বার অবস্থা বেশ ভালাে। আজ রিলিজ দিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল থেকে। বাড়িতে আব্বা খুব ভালাে আছে। সবার সাথে গল্প করছে। আমি একটু খুশি ভাব দেখিয়ে চলে গেলাম বেডরুমে। সিদ্ধান্ত নিলাম শহীদুলকে নিয়েই গল্প লিখব। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে কম্পিউটার খুলে বসলাম। কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারলামনা। ড্রয়িংরুমে তখন শামীমা নিরব দর্শক হয়ে গান শুনছে শহীদুলের। আমি একটা লাইনও
লিখতে পারছিনা। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিয়ে টেবিলে মাথা রাখি। শহীদুলের অদ্ভুত কণ্ঠ কানে আসে। অন্যদিন গান শুনে বিমােহিত হই অথচ আজ ওর গান শুনে কোন ভালাে লাগা নয় কেমন এক অবসাদ কাজ করে। আমি টেবিলে মাথা রেখে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। শহীদুল গাইতেই থাকে।