ভূমিকা ও ভাষান্তরঃ রেজওয়ান তানিম
গত শতকের ইতালিয় সাহিত্য জগতে বিশেষ করে কবিতায় একটি অনিবার্য নাম এউজেনিও মোনতালে। কবি, গদ্যকার, সম্পাদক ও অনুবাদক এ কবি ছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং ইংরেজি সাহিত্য আধুনিক কাব্যধারার গুরুত্বপূর্ণ কবি টি এস এলিয়টের বিশেষ অনুরাগী। তবে এইসব পরিচয়ের চেয়েও বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গীতল কবিতা চর্চায় তার মুনশিয়ানা। প্রথম জীবনে বন্দর নগরী জেনোয়া থেকে ইতালীয় শিল্প, সাহিত্যের রাজধানী ফ্লোরেন্স চলে আসেন। এখানে বেমপোরাড প্রকাশনীতে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৮৯৬ জেনোয়ায় জন্মগ্রহণকারী এই কবি ১৯৭৫ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন, যখন আমাদের দেশে চলছিল অস্থির এক সময়; সামরিক শাসন ও অনির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের উন্মেষ। যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বহু আগেই ‘অন্যদেশের কবিতা’ বইয়ে তার দুটি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন, তথাপি তার কবিতা নিয়ে আমাদের দেশে কিংবা বাংলা সাহিত্য পরিম-লে খুব বেশী আলাপ আলোচনা শোনা যায় না। কিন্তু উল্টোটাই হবার কথা ছিল।
ইতালীয় ভাষার গীতসুধার মত তার কবিতা ভীষণ লিরিক্যাল, সেই সাথে অনেক কবিতাতেই ইতালির ভূ-প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্র্যের দেখা মেলে, যা হয়ত তার অন্তিম বিশ্বাস থেকেই আসত– মানুষ শেষ পর্যন্ত আসলে বড় নির্জন। পৃথিবী অর্থহীন নীরবতার সমষ্টি যেখানে শুধু করণীয় করে যাচ্ছে সবাই, ছকে আঁটা চরিত্রের মত অভিনয় করে যাচ্ছে। মোনতালের কবিতায় আধুনিক জীবনের হতাশা ও ক্রম বঞ্চনার ছায়া আছে, যা আসলে আমাদের নিজেদের ছায়ার মতই আমাদের ছেয়ে আছে কখনো ছেড়ে যায় না। জীবনানন্দের কবিতায় যে বিপন্ন বিস্ময় আমরা দেখতে পাই আমার কাছে মনে হয়েছে এউজেনিও মোনতালের কবিতাতেও তা আছে। তাই বাঙালির চিরকালীন তুলনা করার স্বভাবকে উল্টে দিয়ে আমি বলতে চাই এউজেনিও মোনতালে ‘ইতালির জীবনানন্দ’। প’ড়ো জমির (The Waste Land) কবি এলিয়ট এর গুণমুগ্ধ এই কবি এলিয়টের ষাটতম জন্মদিনে লেখেন ‘এলিয়ট এবং আমরা’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। ১৯৪৮ থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মিলানোতে জীবন কাটান কবি। ১৯৮১ তে তিনি পৃথিবী ছেড়ে মহাকালের পথে পা বাড়ান।
হয়ত সকালে হাঁটায়
হয়ত এক সকালে স্ফটিক স্বচ্ছ বাতাসে হাঁটার সময়,
পেছন ফিরে দেখব পূর্ণ হয়েছে কেমন এক অলৌকিকঃ
কাঁধের কাছে অনস্তিত্বের বয়ান, পেছনের শূন্যতা
ঘিরে রয়েছে আমাকে যেন মাতাল সন্ত্রাসে!
এরপরে গাছেরা সব, বাড়িগুলো কিংবা টিলাশ্রেণি যেন
ছায়াছবির মতন অপসৃত হবে সে চেনাজানা বিভ্রমে,
তবুও বড্ড দেরি হয়ে যাবে আর ফিরব আমি নিঃশব্দে,
পেছন ফিরে দেখেনা যারা, তাদের কাছে নিজস্ব গোপন নিয়ে।
দুপুরে ছায়াসঙ্গম- ০১
দুপুরে ছায়াসঙ্গম, পাণ্ডুর মগ্নতা নিয়ে
রোদ ঝলসিত দেয়ালের পাশবাগানে বসে।
কাঁটাঝোপের ভেতর থেকে, ভেসে আসে
ক্রন্দিত শালিক১ সুর, সাপের হিসহিস।
মাটির ফাটলে কিংবা কলাইক্ষেতে
সারিধরা লাল পিঁপড়ের আনাগোনা চেয়ে দেখি
কখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিংবা পাক খেয়ে
ঘুরে চলে ওই ছোট্ট ঢিবির উপরে।
পাতাল আড়াল থেকে দূরে চেয়ে দেখা
মোহিনী সমুদ্র রঙ, ঢেউয়ের গান
বাতাসের কানাকানি চলে প্রগাঢ় কম্পনে
ঝিঝি ধ্বনি ভেসে আসে নগ্নটিলা থেকে।
হেঁটে চলা এই সূর্য সমন্বিত দিন
মনে হয় যেন এক বিপন্ন বিস্ময়
এই যে জীবন আর তার প্রভূত শ্রম
সব যেন পাশের ওই দেয়ালটির অনুগামী
সেজেছে যে ভাঙা বোতলের কাঁচে।
দুপুরে ছায়াসঙ্গম -০২
মুক্ত করেছি ললাট তোমার বরফ ছোবল থেকে
আর পুঞ্জীভূত করেছ তুমি ওই উঁচুতে পাক খাওয়া
মেঘদল; বিক্ষত হয়েছে পালকমালা তোমার
ঘূর্ণিবায়ুর তোড়ে, জেগেছ অকস্মাৎ বজ্রপ্রভায় ।
মধ্যাহ্নে: খোবানি২ গাছের ছায়া ক্রমশ ছড়াতে থাকে
চারদিক জুড়ে, আর একটা শীতল সূর্য হেলে থাকে
আকাশের নীলে; আর অন্য ছায়ারা হারিয়ে যায়
কানাগলিতে, জানে না যেখানে মিশে আছ তুমি।
সুখলাভ, এমন হাঁটায়…
ছুরি ফলার প্রান্তে অমন হেঁটে হয়তবা পেয়েছিলে
তুমি আশ্চর্য কেমন এক প্রসন্ন চিত্তের দেখা।
আমাদের চোখে তুমি যেন চমকিত ডুবোঝড়
সদাচঞ্চল, টানটান বরফে ফাটল ধরায়; তাই
ভালবাসে সর্বাধিক যে, স্পর্শ বঞ্চিত সে তোমার!
যখনি তুমি আস, অমনি প্রেতাত্মারা হানা দেয়
প্রভূত দুঃখবোধ আরো তীব্র করে, মিষ্টি সকালটা
উপদ্রুত মনে হয় উঁচুতে বাঁধানো পাখির বাসার মত।
আর শিশুদের অশ্রুপাতে কিছুই থাকেনা ক্ষতিপূরণ দেবার
যার বেলুনটি উড়ে যেতে থাকে ঘরগুলোর চালার ফাঁকে।
টীকা:
১) ইউরোপীয় ব্লাকবার্ড আমাদের দেশীয় শালিকের কাছাকাছি একটি পাখি যা একই Turdidae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ইউরোপের সর্বত্র এ পাখি দেখতে পাওয়া যায়।
২) মেডলার বা খোবানি গাছের ফল আপেলজাতীয় এবং আকারে ছোট। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে এই ফল বেশী দেখা যায়। খেতেও বেশ সুস্বাদু ও রসালো এ ফল।