পারস্যের কিছু কবিতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

বাংলারূপ: নাসিরুল ইসলাম 

মাওলানা জালালউদ্দিম রুমি- এর কবিতা

রুমির (মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি,১২০৭-১২৭৩) মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সর্ব ধর্ম এবং সর্ব বিশ্বাসের লোকেরা এসেছিল। একজন মুসলিম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কেন এসেছো? ওরা উত্তর দিলো, ‘তাঁর কবিতা  আমাদের সমস্ত জীবনকে, আমরা এই পৃথিবীতে যে-যেখানে যে-জীবন যাপনই করি না কেন, তাকে গভীর করে তুলেছেন।’—এই হচ্ছে সেরা পারস্য প্রতিভা, রুমি। আপনি যে মুহূর্তে এই লেখাটি পড়ছেন, সেই মুহূর্তেও পৃথিবীর কোনো-না-কোনো প্রান্ত থেকে রুমির বই বিক্রি হচ্ছে। বলা হয় যে, কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া কবিতার বই, রুমির কবিতার বই। কেন? সে জিজ্ঞাসা পাঠকের মনেও জেগে উঠুক। এখানে তাঁর কয়েকটি কবিতার ভাবানুবাদ পেশ করা হলো। কবিতাগুলো তাঁর “খরঃঃষব নড়ড়শ ড়ভ ষরভব” থেকে নেওয়া হয়েছে।

১.

একদিন খুব ভোরে বাগান থেকে

আমি একটি ফুল তুললাম,

হঠাৎ করে বাগানের মালী এসে পড়লো,

এবং

আমি ভয়ে আতংকে

থর থর করে কাঁপতে লাগলাম,

মালী বললো,“যেখানে আমি

সমস্ত বাগান তোমাকে দিয়ে দিয়েছি,

সেখানে একটা ফুলের জন্য

তুমি  দুশ্চিন্তা করছো!”

২.

জ্ঞানোনমত্ত পণ্ডিত,

নেমে এসো চূড়া থেকে,

এমনভাবে ডুবে যাও

প্রেমের গভীরে, যেন তুমি

নির্জ্ঞান, নির্বোধ!

একটি ধূলির বিনয় জাগুক

তোমার শরীরে,

কী তরুণ, কী বৃদ্ধ, কী ভালো,

কী মন্দ,– এ- যাত্রায় যদি

সাথে নাও সবাইকে, তবেই

তুমি  হবে অধিশ্বর, একদিন।

৩.

তোমার সমস্ত ঝুড়ি ভরে আছে রুটিতে,

তবু তুমি সামান্য এক টুকরো

রুটির জন্য

ঘুরে বেড়াচ্ছ দ্বারে দ্বারে। 

তোমার হাঁটু অব্দি জল,

তবু 

যেই চলে গেল এই পথ দিয়ে

তার কাছে চাইলে

এক ফোঁটা তৃষ্ণার জল।

কেন তুমি এত অন্ধ,  অচল?

সব ছেড়ে ফিরে আসো,

শুধু হৃদয়ের কাছে

ভিক্ষা চাও। 

৪.

হৃদয়, বিবেচক হও,

আত্মা, সহিষ্ণু হও,

ধৈর্য, যদি বইতে না পারো

দুঃখের ভার, তবে পালাও,

আর যুক্তি, যাও, তুমি তোমার 

শিশুতোষ খেলাগুলো খেলো। 

৫.

যে দুঃখ হৃদয়ের গভীরে,

যদি প্রকাশ করো,

সে নেই হয়ে যাবে।

একটি ফুলের দিকে তাকাও,

দেখো,

সে কখনোই তার 

গন্ধ, রঙ

কিছুই লুকোয় না। 

৬.

তোমাকে হারানোর পর থেকে,

এই বসন্ত আর কোনো আনন্দ বয়ে আনেনি,

সমস্ত বাগান ঢেকে গেছে কাঁটায়,

সমস্ত পাথর গলে বৃষ্টি পড়ছে।

৭.

নিজেকে হারিয়ে

আমি ঈশ্বরের অনুবাদক বনে গেলাম,

এখন, পানোনমত্ত অথবা অনুনমত্ত,

যে অবস্থায়ই থাকিনা কেন,

মুখ থেকে কোনো শব্দই আর বের হয়না।

৮.

আমার সমস্ত শিরায় প্রেম বয়ে গেল,

এবং আমি শূন্য হয়ে গেলাম।

এখন আমার সমস্ত জুড়ে আছে সে,

আর আমার সম্পদ বলতে নিজের

নাম ছাড়া আর কিছু নেই। 

৯.

রাতে প্রবল বায়ুর মতো

আমি শহরময় বিচরণ করি,

ঘুম নেই চোখে,

ভদ্রলোকেরা 

বারবার

বিষয়-বুদ্ধির দিকে আমার চোখ ফেরাতে চায়,

কিন্তু আমার মন তা শুনতে অপ্রস্তুত,

কারণ ভালোবাসার এই মদে

আমি

লুপ্ত এবং মত্ত হয়ে আছি। 

১০.

আমার চিন্তা গভীর আবেগের মধ্যে

ঘুরপাক খাচ্ছে,

আমার হৃদয় বাতাসের মধ্যে ঘুরছে,

যেমন করে উঁচুতে 

পাখিরা ঘুরতে থাকে,

আমার সত্ত্বার 

প্রতিটা পরমাণু ঘুরছে,

আমার ভালোবাসার মানুষও কি

ঘুরছে—- সমস্ত চরাচরে,

এমনি করে?

আইয়ান আল কোজাত হামাদানি’র কবিতা

আইয়ান আল কোজাত হামাদানি পারস্যের হামেদান শহরে ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন। বিখ্যাত দার্শনিক এবং মরমী সাধক। জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁর কেটেছে জেলে। তেত্রিশ বছরের জেল হয়েছিল তাঁর বৈধর্মের জন্য। তিনি বিখ্যাত আবু হামেদ গাজ্জালীর উপর ব্যাপক পড়াশোনা করেন এবং পরে তাঁর ভাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। তাঁর ভাইয়ের কাছে লেখা চিঠিগুলি জগৎ-বিখ্যাত। তাঁর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কাজ ‘তামহিদ’, এটা শুধুমাত্র ফরাসি ভাষায় অনুবাদ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে তাঁর একমাত্র যে অনুবাদটি পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে, ‘সাকওয়া-ই-গারিব”। এই বইটি তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে, জেলে থাকা অবস্থায় লিখেছিলেন। নীচে যে কবিতাটি পেশ করলাম, সেটি তাঁর সবচেয়ে বহুল পঠিত কবিতা।

ণ্ডাংশ ১

না-থাকার গভীরে আরো

এক গভীর না-থাকা,

সেই আমার নিয়ম।

হারিয়ে যাবার গভীরে

আরো এক গভীর

হারিয়ে যাওয়া,

সেই আমার ধর্ম। 

ণ্ডাংশ ২

আমি জানি,

এই-যে যেখানে তুমি আছো,

সেখানে আমি আসতে পারি না ;

আমি জানি,

এই-যে যেখানে আমি আছি,

সেখানে তুমি আসবে না ;

আমি জানি।

ণ্ডাংশ ৩

হায়! ঐ চোখ কী

কখনো তার

মুখ দেখেনি!

ঐ হৃদয় কী

কখনো তার

চোখের পাপ

অনুভব করেনি!

পরম তৃষ্ণা

যতদিন এই প্রাণ প্রাণময়,

তোমাকে ভালোবাসার

দুঃখ আমি

পান করে যাব,

মৃত্যুর কালেও

কাউকে দেবনা

তার ভার,

কাল

পুনরুত্থানের দিনে,

এই পরম তৃষ্ণা নিয়ে

হেঁটে যাব সম্মুখে। 

নিষিদ্ধ হেরেম

যদি আমার পা দুটো অসার

হয়ে আসে, তোমার পিছে

ছুটবো না, ভেবনা

আমার হৃদয় তোমার

ভালোবাসার জালে আটকা পড়েনি,

ভেবনা, তোমার প্রেম বহুজনে,

এই ভেবে আমি স্থাণু;

আমার চোখ নিষিদ্ধ হয়ে আছে

তোমার দৃষ্টির হেরেমে। 

দরজায় কড়া নেড়ে চলেছে যে

আমার সমস্ত স্বপ্ন জুড়ে ছিলো সে,

ঠোঁটের উপরে ঠোঁট,

স্তন ছুঁয়ে ছিলো স্তন;

তার কানে কানে বললাম,

“আমার হৃদয়, এই রাত্রিকে

অশেষ করে তোলো…”

হঠাৎ জেগে উঠে দেখি,

আমি শুধু দরজায়

কড়া নেড়ে চলেছি।

নাজমদ্দিন কোবরা

নাজমুদ্দিন কোবরা ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে খিভায় (খাওয়ারাজাম নামে পরিচিত) জন্মগ্রহন করেন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি এখানেই কাটান। তিনি বিদ্যাশিক্ষার জন্য নিশাপুর, পরে, মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়ায় যান, যেখানে তিনি রাজবেহান আল-ওয়াযান আল-মেসরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি নিজে একজন মহান সুফি সাধক ছিলেন। ১২২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি যুদ্ধে মারা যান।

নীচের কবিতাটি তাঁর বহুল পঠিত একটি কবিতা। 

যা-কিছু অস্তিত্বমান নয়, তা

হাতে একমুঠো হাওয়া ছাড়া আর

কিছুই রেখে যায় না;

যা-কিছু  অস্তিত্বমান, তা

ব্যর্থতা ও অপূর্ণতা ছাড়া আর

কিছুই দিতে পারে না ;

সেক্ষেত্রে, একজন শুধু স্বপ্ন দেখতে

পারে তারই—-যা কখনই ছিলোনা;

এবং সেজন্যই সে সত্য;

মনে রেখো,

এই সত্য কখনোই অস্তিত্বমান নয়।

মন্তব্য: