কবিতার অনুবাদ ও বিকৃতি প্রসঙ্গ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

নিষাদ নয়ন

অনুবাদ শব্দের অর্থ বা যুতসই মানে অনুকথন। অনুবাদ শব্দটি নানাবিধ অর্থে ব্যবহার করা হয়। এখন এর সমার্থক হিসাবে তরজমা বা ভাষান্তর ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু কবিতার অনুবাদ আর তরজমা কিংবা ভাষান্তর এক অর্থ বহন করে না। অনুবাদ শব্দের প্রথম উপস্থিতি আমরা কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ এর একটি পয়ারে দেখতে পাই। ‘বিধেয় কহিয়ে তারে যে বস্তু অজ্ঞাত।/অনুবাদ কহি তারে যেই হয় জ্ঞাত।।’ এই পুরানো পয়ার থেকেও অনুমান করা যায় যে, অনুবাদ আর তরজমা বা ভাষান্তর একই অর্থে প্রযুক্ত নয়। কবিতার অনুবাদ অবশ্যই হতে হবে অর্থবহ। যদি সত্য থেকে সরে যাওয়া হয়, তাকে বিকৃতি বলা যায়। একই রকম অনুবাদের সময় মূলানুগ কবিতা থেকে দূরে সরে গেলে তাকেও বিকৃতি বলা যেতেই পারে। অর্থাৎ প্রকৃত কবিতা থেকে কৃত্রিম উপায়ে জাত যেকোন কিছুই কবিতার বিকৃতি।

শব্দ কবিতার মূল উপকরণ। যেমন ছবিতে আলো-ছায়া-রেখা থাকে। আবার সেই শব্দই কবিতার বিভা হরণ করার হাতিয়ার হিসেবে অনায়াসে সফল। অনুবাদ বা ভাষান্তর মূল কবিতার সারানুবাদের ক্ষেত্রে কবিতার সংবেদন অক্ষত রাখা খুব কঠিন। কবিতা অনুবাদের কিছু মৌলিক সমস্যা সব সময় থাকে তার থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। কবিতার থেকে শব্দার্থ বাদ দিয়ে তার মূল ছন্দ, মিল, বাকরীতি, উপস্থাপন শৈলী, অলঙ্কার, প্রকরণ সহ ভাষিক সৌকর্য ঠিক রেখে রস ছেঁকে তুলে আনা বা বের করা মোটেই সহজসাধ্য কাজ নয়। কবিতার শরীরে কখনও দৃশ্যমান, আবার কখনও অদৃশ্যের বুনন থাকে। যা দুই লাইনের মধ্যে অনুক্ত থেকে যায়, শুধু সমঝদার পাঠক বারবার পড়ে বুঝে নিতে পারে কিভাবে ঝলমলিয়ে হাসে কবিতা। কবিতার সাথে গল্প বা উপন্যাসের অনুবাদের বিস্তর পার্থক্য দৃশ্যমান। কবিতায় শব্দের কারসাজি প্রকট মনে কখনও কখনও, তবে তার মধ্যে সুন্দরকে সংক্রমিত করার এক ধরণের চেষ্টা বা আভাস থাকতেই হয়। কবিতার ভিতর সংক্রমণ ক্ষমতা থাকে, ছুঁয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে আর লুকানো থাকে সংবেদনশীল মানুষের মনের অনুরণন। 

কবিতা অননুবাদ্য এমন কথা বলা হয় থাকে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও মনে করতেন কবিতা অনুবাদ করা যায় না। তবে তিনি দেশি-বিদেশি অনেক কবির কবিতা থেকে অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন, ইয়েটসের সাথে যৌথভাবে নিজের কবিতার অনুবাদও করেছেন। তাঁর পূর্বজ কবি বড়– চন্ডীদাস, মধুসূদনও অনুবাদ করেছেন। চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এ জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ থেকে কিছু ভাবানুবাদ সাদৃশ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। মধুসূদন লাঁ ফতেনের কবিতা অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন। এছাড়া বাংলা কবিতার মধ্যযুগের অধিকাংশ কবি সংস্কৃত ভাষা ভালো জানতেন। মঙ্গলকাব্য, পদাবলী আর বৈষ্ণব কাব্যেও ভাবানুবাদের প্রভাব আছে। আধুনিককালে রাজশেখর বসু , কালীপ্রসন্ন সিংহ  বা হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের রামায়ণ আর মহাভারতের গদ্যে কাব্যময় সারানুবাদ করেছেন। নজরুলের অনুবাদও তাঁর স্বাতন্ত্র, স্বক্রিয়তার কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে তা বেশ খানিকটা আরবি-ফার্সি ছন্দের বাংলায়ন মনে হয়।

রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানান্দ যে ভাষায় কবিতা লিখেছেন, তা ছিল স্ব-স্বতন্ত্র। রবীন্দ্রনাথ একটি ভাষার ভিতর অন্য ভাষার জন্ম দিলেন। আর সেই ভাষাকে জীবনানান্দ করে তুলেছেন বহুমাত্রিক-বিভাময়। যাকে অননুবাদ্য বলা যেতেই পারে। রাদিচে বা অন্য যে কারো ইংরেজি অনুবাদে রাবীন্দ্রিক কবিতার ছন্দ আর স্বর অনেকটা পাল্টে গেছে। বরং  কবির স্বকৃত অনুবাদ অনেক বেশি প্রাঞ্জল আর সংবেদনশীল মনে হয়। কবিতা স্ব-ভাষায় যত দ্যুতিময়, অন্য ভাষায় ততটা সংবেদনশীল নয়। কবিতাকে শুধু শব্দের সমাবেশ ভেবে, ভাষান্তরকরণ করার বিষয় একেবারেই নয়। অনুবাদে মূল কবিকীতি অনুপস্থিত থাকবেই মেনে নিলেও মূলের স্বাদ থাকা দরকার। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ বাংলা কবিতার ধারায় মিশে নতুন এক আবহে রাধা-কৃষ্ণ প্রামাণ্যপুরান হয়েছে- ‘মরণ রে তুহুঁ মম শ্যাম সমান’। কবিতার ভাষা আর কবিতার ভাষান্তর স্বতন্ত্র যোজনার মধ্যে অনুবাদ বহুলাংশে প্রথম সৃষ্টির মতোই। এক্ষেত্রে তরজমা থেকে ভাষান্তর, আর ভাষান্তর থেকে অনুবাদ একেবারে আলাদা। 

এই তিনের মধ্যে উদ্দেশ্য আর ব্যবহারকেন্দ্রিক পার্থক্য বিদ্যমান। কোনো ভাষা থেকে তরজমা করা হয় মূলত মূলরূপ বা ভাষারূপকে আরো সহজ, বোধগম্য করার জন্য। এ দিক দিয়ে অনুবাদ আর ভাষান্তর কিছুটা কাছাকাছি। অনুবাদ মূলানুগ করার দাবি থাকে বেশি। অন্যদিকে ভাষান্তর একটি দ্বিভাষিক রূপান্তর প্রক্রিয়ার মতো। এক বা একাধিক ভাষা থেকে শব্দগত সাদৃশ্য ঠিক রেখে একধরণের আক্ষরিক অনুবাদ। এক্ষেত্রে অনুবাদক নিজের ইচ্ছেমাফিক তার রুচি আর বাকরীতি নির্ধারণ করার কিছুটা স্বাধীনতা পেয়ে থাকে, নিজের মতো করে নেয়। ভাষাগত রূপান্তর আর কবিতার প্রকৃত অনুবাদ করার ক্ষেত্রে মূল কবিকীতি থেকে সরে যাওয়া  বা দূরবর্তী হওয়ার জন্য পূর্বজ বা সমকলের অনেক কবি-অনুবাদককে মূল কবিতা বিকৃত করার দায় বহন করতে হয়েছে। কবিতায় যে শব্দসমূহ সমাবেশ বা সমাহার ঘটানোর মধ্যদিয়ে শব্দের অর্ন্তজাল বুনন করা হয়, তার ভিতর অসংখ্য আড়াল-আভাস থাকে। দৃশ্যমান শব্দ অব্যবহৃত শব্দকে আড়াল ভাঙার আহ্বান জানাতে থাকে, যা কবিতার ভাষিক সৌন্দর্য তুলে আনে কবিতার শরীরে। এই যে শূন্য শব্দ না থেকেও পূর্ণ, সফল আর শক্তিশালী কবিতাকে দ্যুতিময়, আলোড়িত করে তোলে। সার্থক কবিতায় অন্তর্গত অনুরণন থাকে। এই গুণ সতত অনুবাদ বা ভাষান্তরে অক্ষুণ্ন রাখা ভীষণ কঠিন। এজন্য অনুবাদ্য কবির কবিতা নির্বাচনের সময় অনুবাদককে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত। কবিতার শব্দসমূহ উচ্চারণ বা পাঠান্তে সরব বা নিরব ব্যঞ্জণায় ঋদ্ধ পাঠককে ঘোরগ্রস্ত করে তোলে, যা এক কথায় কবিতার সংক্রমণ বলা যেতে পারে। 

কবি অরুণ মিত্র, অনুবাদের সমস্যা নিয়ে লিখেছেন, ‘অনুবাদ অর্থাৎ এক ভাষাকে আর এক ভাষায় রূপান্তরিত কার এমন কাজ যার প্রতি পদেই সমস্যা। একদিকে যেমন যান্ত্রিক হবার তাগিদ, অন্যদিকে তেমনি মৌলিক হবার আহ্বান, এই দুই পরস্পর-বিরোধিতার মাঝখানে তার পথ চলতে হয়। এ কাজের প্রকৃতি প্রথম থেকেই দ্বৈত। নিজের ভাষায় মগ্ন হয়ে নিজের খুশিতে লিখে যাওয়া নয়, একই সঙ্গে দুই ভাষার স্তরে মনকে নিযুক্ত রাখা, দুই ভাষা নিয়ে মাথা ঘামানো এবং দুই ভাষার চালচলন পদ্ধতিপ্রকরণের উপর প্রতিমুহূর্ত নজর রাখা। সুতরাং অনুবাদকর্মেও প্রথম শর্তই হল দুটি ভাষা সম্বন্ধে পর্যাপ্ত জ্ঞান। সমান জ্ঞান বলব না। কারণ এ কাজের একদিকে পাল্লা ভারী হবেই, যে-দিকটায় জ্ঞানের সঙ্গে অনুভবও যুক্ত হয়। যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয় সেই ভাষা প’ড়ে তার সঠিক অর্থ বোঝাই আসল, যেহেতু সেই ভাষায় অনুবাদক লিখছেন না, তিনি পড়ছেন। কিন্তু যে ভাষায় করা হয় সেই ভাষায় অনুবাদকের নিগূঢ় জ্ঞান থাকা দরকার, যেহেতু সেই ভাষায় তিনি লিখছেন।’ এই উল্লেখ্যের পর বলে রাখা ভালো টি.এস. এলিয়ট খুব ভালো ফরাসি জানতেন কিন্তু তাঁর ফরাসি কবিতার অনুবাদেও অনুবাদ্য কবির মূলানুগ অনুবাদ করতে পারেন নি এবং তিনি স্বীকার করেছেন ভাষান্তর করার ক্ষেত্রে কবি-অনুবাদক লাগামহীন হতে পারেন না।

অনুবাদ কবিতার কিছু মৌলিক সমস্যা আছে, তা পাঠককে স্বীকার করে নিতে হবে। তবে তাই বলে অনুবাদ কবিতা পড়া বাদ দিতে হবে এমন নয়। অনুবাদ এখন সাহিত্যের পৃথক শাখার রূপ পেয়েেেছ বা পাচ্ছে এমনটাই মনে করা হয়। এই অনু-বিকল্প সৃজনেরও একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সম্ভবত দান্তে পরবর্তী কাব্য-সাহিত্যের অগ্রযাত্রায় ইতালিতেই প্রথম অনুবাদের শুরু হয়েছিল। তারপর ব্রিটিশ শাসনামলে সেই ইংরেজদের হাতেই অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশ লাভ করেছিল। প্রত্যেক ভাষার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি, অলঙ্করণ, ভাষা বা বাকরীতি থাকে। এসবের অন্তর্গত বহুবিধ ভাষাবিন্যাস থাকে, যা অন্য ভাষা ঠিক একইভাবে নিয়ে আসা বা আরোপ করা যাবে না। অনুবাদ আবৃত্তির মতোই একপ্রকার অনুকারণ। যা সৃষ্টিশীল কাজ নয়। এ যেন রান্না করা আর পরিবেশন করার মধ্যেকার ব্যবধান। তবে কবিতার অনুবাদ অনায়াসে আসে না তা অনেকটা সৃজনকর্মের মতোই। অনুবাদক একপ্রকার মূল কবির ক্রীড়নক হিসেবেই কাজ করে। কবিতা অনুবাদের সাথে গদ্য বা কথাসাহিত্য অনুবাদের মূল পার্থক্য: আক্ষরিক অনুবাদে কবিতার কাঙ্কাল পড়ে থাকে আর গদ্যে বাস্তবিকতা। কবিতার অনুবাদককে নানাবিধ বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়। যেমন মূল কবির বক্তব্য, শৈলী, আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য আর ভাবগত ঐক্য। এজন্য শুধু  ভাষাজ্ঞান থাকলেই হবে না, থাকতে হবে বিশিষ্ট সূক্ষ্মতা, দৃষ্টির তীক্ষèতা। কবিতার অন্তর্লীন ভাবগত মিল অক্ষুণœ রেখে অনুবাদ করার জন্য কোনো মানদ- নেই। তবে কবিতার অনুবাদ অবশ্যই কবিকে করতে হবে, এমন দাবি খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। তার কারণ একজন মূলত কবি বা ভুলত কবিই কবিতার সারানুবাদ করতে পারেন, তা না হলে অনুবাদকের মধ্যে কাব্যপ্রবণতা বা কাব্যময় অন্তর্দৃষ্টি থাকতে হবে, তবেই কাব্যগন্ধি অনুবাদ পাওয়া যেতে পারে। আক্ষরিক কবিতার অনুবাদকে মৃত শব্দের জঞ্জাল বললেও কম বলা হবে। অর্থাৎ আক্ষরিক কবিতার অনুবাদ কোনো অনুবাদ নয়।

অনুবাদের সঠিক উপায় বা পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। প্রত্যেক অনুবাদক তার খেয়াল খুশি মতো অনুবাদ করে আসছে। মূলানুগ অনুবাদের ক্ষেত্রে কবিকে বিদগ্ধ হতেই হবে এমন নয়। মূল ঠিক রেখে অনুবাদকৃত কবিতার ভিতর বিদেশি ভাবজাত হলে কোনো ক্ষতি নেই। তবে একদম দেশীয় করাও বোধ হয় উচিত নয়। অরুণ মিত্র, অনুবাদ করার ক্ষেত্রে দুই রকম পদ্ধতির কথা বলেছেন- ‘এক পদ্ধতি ভিনদেশী লেখককে পাঠকের ভাষার জগতে নিয়ে আসা। অন্যটি হল পাঠককে ভিনদেশী লেখকের ভাষার জগতে নিয়ে যাওয়া।’ প্রত্যেক শক্তিশালী কবির কবিতায় নানামুখি বৈচিত্র্য থাকে, সেই অন্য ভাষার কবিতার স্বর, রূপগত, ভাবগত, ছন্দ, মিল বা কাব্যময় গদ্য আবেদন ভাষাজ্ঞান আয়ত্ত করে অনুবাদ সম্ভব নয় এটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে। কবিতার নির্যাস ভাল লাগার সংক্রমণ, অন্তর্লীন সংবেদন। হয়তো এই জন্য রবীন্দ্রনাথের অনুবাদেও নিজের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রাবীন্দ্রিক ভাষার অনুরণন ইংরেজি অনুবাদে শোনা যায়। দেবেশ রায়ের বয়ানে, ‘ শব্দার্থ ছাড়া কোনো কবিতার উপকরণ নেই। সেই শব্দের বিন্যাসে কখনো আরো ঝলমলিয়ে উঠতে পারে, রঙ দৃষ্টিগ্রাহ্য ঠেকতে পারে, ছায়াপাত ঘটে গেল মনে হয়।’ শব্দার্থ কবিতার অনিবার্য পরিনাম হতে পারে না। অন্যভাষায় কবিতার যে নন্দনকানন লুকানো থাকে তাকে উদ্ভাসিত করা, আলোড়িত করা কবিতা অনুবাদের মূল লক্ষ্য। অনুবাদ করার পর কবিতাকে হতে হবে এক নান্দনিক অভিজ্ঞতার ভাষা ডিঙিয়ে উজিয়ে ওঠা মূল কবিতার দ্যোতনা। কৃত অনুবাদ্য কবিতায় অনেক ক্ষেত্রে অহেতুক ভাব-সম্প্রসারণ বা সংকোচন করা হলে তার আবহ আর অন্তর্গত গতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। অদৃশ্য বা শূন্য শব্দ আড়ালে থেকেও যে আবহ-প্রবাহ জাগায় তাই কবিতার দ্যোতক। এর অন্যথায় বাহ্যার্থ প্রকট হয়ে ওঠে। কবিতা আর অনুবাদ কবিতা, কাকের বাসায় কোকিলের ডিম থেকে তা দিয়ে বাচ্চা হওয়ার মতোই ঘটনা। যেমন রাদিচে আর রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ পৃথক আর স্বতন্ত্র। শুধুমাত্র  শব্দার্থের প্রতিস্থাপন বা সমার্থক জুড়ে দিলে তা কবিতাকে আরও বেশি বিকৃতির পথে নিয়ে যায় বা যেতে পারে। কবিতার বাকরীতি গদ্য বা কথাসাহিত্য থেকে অনেক আলাদা তাই অর্থগত, ভাবগত সর্ম্পক অটুট রাখার বদলে বিকৃতি ঘটানো অনেক সহজ। কাব্যিক ছোঁয়া আর অন্তর্গত বয়ান উদ্ধার করার ক্ষেত্রে অনুবাদ কখনও সহায়ক নয়। কবিতা লেখা আর তার অনুবাদের মধ্যে তুলনামূলক কবিতাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা এ যেন তারই এক মহরা। কবিতার অনুবাদ এক নান্দনিক ভ্রমণ, ছায়াপাত থেকে আলোর পৃথক উপস্থাপন করার মতো। অনেক প্রতিভাদীপ্ত কবির কাব্যভাষা একবারেই আলাদা সেক্ষেত্রে সেই স¦কৃত কবিতার সফল অনুবাদ সেই স্বতন্ত্র কবির পক্ষেই করা সম্ভব।

‘কথা কইতে জানলে হয়, কথা শত ধারায় বয়।’ এই প্রবচন কবিতার অনুবাদ সম্পর্কেও যথার্থ মনে হয়। অনুবাদ কবিতায় অনিবার্য আর মোক্ষম অস্ত্র শব্দ তবে একভাষা থেকে অন্য ভাষার যে শাব্দিক যোজনার ফলে এক কৃত্রিম অধিভাষার জন্ম হয়। তখন একই কবিতার একাধিক পৃথক পৃথক অনুবাদ পুনর্লিখিত কবিতা মনে হয়। যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর অমিয় চক্রবর্তীর শেক্সপিয়রের সনেটের অনুবাদ। অনুবাদকে নিরুৎসাহিত করার পেছনে অনুবাদ বিকৃতিই মূলত দায়ী। অনুবাদের প্রসঙ্গে ক্ষুরধার প্রাবান্ধিক প্রমথ চৌধুরীর উক্তি, ‘উৎসভাষা ভালো করে জানা তত দরকারি না, যে ভাষায় অনুবাদ করা হবে সে ভাষা জেনে নেওয়া চাই।’ এত কিছুর পরও কবিতা অনুবাদের হিরিক কিন্তু কমেনি বরং বেড়েছে। প্রতিদিন কবিতার অনুবাদ ভাষিক বিনিময় ছাড়া আর কোনো তাৎপর্য বহন করে কিনা তা ভাবা দরকার। এর পেছনে কবিতাপ্রিয় পাঠকদের আগ্রহ বেশি কাজ করে, নাকি অনুবাদকের  ব্যক্তিগত তৃপ্তি তা আমাদের সঠিক জানা নেই। যেমন আধুনিক সময়ে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় অনুবাদকৃত  জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ অনেক প্রশংসা আর পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এক্ষত্রে বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদকৃত ‘মেঘদূত’, ও ‘শার্ল বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের হুইটম্যানের অনুবাদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কুমারসম্ভাব কাব্য’, লোকনাথ ভট্টাচার্যের র্যাঁবোর ‘নরকে এক ঋতু’, অঁরি মিশোর কবিতা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিদেশি কবিতার অনুবাদ’, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোরকার ‘ষাঁড় ও কিন্নর’, ‘জর্জ সেফেরিসের নির্বাচিত কবিতা’, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ‘গুন্টার গ্রাসের কবিতা’, অমিতাভ চৌধুরীর ‘পাবলো নেরুদা’, ‘রাইনার মারিয়া রিলকের কবিতা’, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদসমূহ পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে; এছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য কবিতার অনুবাদ আছে। ভালো অনুবাদ যেমন আছে দুর্বল বা বিকৃত অনুবাদও প্রচুর আছে। যেমন  সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কিছু অনুবাদ, বিষ্ণু দে’র টি এস এলিয়ট, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাজিম হিকমতের অনুবাদসহ এমন প্রচুর বিদেশি কবিতার অননুবাদ্য কবিতার বাংলায়ন হয়েছে, আরও হয়তো হবে এবং হতেই থাকবে। 

অনুবাদ কবিতার বহুমাত্রিক সীমাবদ্ধতা থাকবেই এ সর্বজন বিদিত। তবে কবিতার আদর্শ বা যথার্থ অনুবাদ বলে কিছু হয় না, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বাংলাভাষায় মূল ভাষা থেকে খুব কম অনুবাদ করা হয়। এ কাজের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রভাব অগ্রগণ্য স্বীকার করতেই হবে। অনুবাদ্য কবিতার একাধিক অনুবাদের পর মূলানুগ কবিতার কঙ্কাল অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এক কথায় কবিতার অনুবাদ ভাষাগত বিনিময় আর  অন্য ভাষা না জেনে কবিতায় ভ্রমণ করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় পাঠককুল। 

মন্তব্য: