শওকত ওসমানের সমাগম: সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবিরোধী নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মুসাফির নজরুল

শওকত ওসমানের (১৯১৭-১৯৯৮) নিরীক্ষাধর্মী অভিনবত্বের জাজ্জ¦ল্যমান প্রতিচ্ছবি ‘সমাগম’ উপন্যাস। এ উপন্যাসের প্রতীকের অন্তরালে বিশ্বমানবতা, বিশ্বভ্রাতৃত্বের পক্ষে এবং সাম্রাজবাদ ও যুদ্ধবিরোধী একটি গভীর বক্তব্য উত্থাপিত হয়েছে। সমকালীন জীবনবোধের প্রেক্ষাপটে মৃত  লোকের বাসিন্দা কয়েকজন বিখ্যাত মনীষীর নাটকীয় আবির্ভাব, তাদের কথোপকথনের মাধ্যমে কয়েকটি বাণীর মধ্য দিয়ে সুস্থ জীবনবোধ ও আশাবাদী চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে। সমাজের অবক্ষয়ের প্রেক্ষিতে মানুষের নৈতিক অবমূল্যায়নের ফলে, মানবিক বোধের অবলুপ্তি ও আত্মিক শূণ্যতার পরিণাম যে তার বিকৃতি ও মূল্যবোধহীনতা- তা এ উপন্যাসে লেখক অত্যন্ত সার্থকতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন।

‘সমাগম’ উপন্যাসের কাহিনী অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক। ঢাকার একটি পত্রিকার সাব-এডিটর জুহার কাছে মধ্যযুগীয় রোসাঙ্গের রাজকবি মহাকবি আলাওল চিঠি পাঠিয়ে উপযাচক হয়ে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। প্রায় তিনশ’ বছর আগেকার তুলট কাগজে মধ্যযুগীয় বাংলায় লেখা চিঠির পাঠোদ্ধার করে জুহা জানতে পারেন ‘সহস্র বাইশ মঘী সন রোজ রবিবার’- অর্থাৎ পরবর্তী রবিবার মহাকরি আলাওল তাঁর বাড়িতে বেড়াতে আসবেন।

“বিসমিল্লা প্রভুর নাম আরম্ভ প্রথম।

অতঃপর নিবেদিত সালাম আলেকন ॥

খাহেস হৈল তাহে মুসাফির হৈয়ে।

পৌঁছাইমু একা একা তুহ্মার আলয়ে॥

মুনশী করিয়ে দেহ কুশল- খবর।

নেক নাম নেক কাম পুত্র -বরাবর ॥

দোওয়া খায়ের মাঙ্গিঁ  তুহ্মার কারণে।

রোসাঙ্গের হীন কবি আলাওল ভনে ॥”

মহাকবি আলাওলের এ চিঠি জুহাকে যার পর নাই পুলকিত ও শিহরিত করে। তিনি স্ত্রী জাইদুনকে চিঠির মর্মার্থ খুলে বলেন। আলাওলের আগমন উপলক্ষে মেয়েদের মধ্যে কবি চন্দ্রাবতীকে রাখতে চাইলে জাইদুন বেগম রোকেয়াকে ডাকার প্রস্তাব করে। কিন্তু, উপন্যাসে চিঠিতে উল্লেখিত আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, কবি চন্দ্রাবতী বা বেগম রোকেয়া শেষ পর্যন্ত অনুপস্থিত।

আলাওলের আগমন উপলক্ষে আমন্ত্রিতদের মধ্য থেকে এসেছেন – আলাওল, বার্নার্ড শ’, রমাঁ রলা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হাজী মোহাম্মদ মহসীন এবং রাতের শেষ পর্যায়ে অনাহূত অবস্থায় আবির্ভূত হন লিও তলস্তয় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাদের জ্ঞানগর্ভ কথোপকথন এবং বিতর্কে অত্যন্ত মোহনীয় হয়ে ওঠে সেই রাত্রি। এমন একটি কাল্পনিক ও উদ্ভট আখ্যান রচনার কারণ উপন্যাসের সূচনায় পাঠকচিত্তে কৌতুহলের সৃষ্টি করলেও শেষ পর্যন্ত তা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। লেখক এক বিশ্বজনীন সর্বমানবিক চেতনায় উত্তরণের পথ নির্দেশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে ডক্টর রফিকউল্লাহ খানের একটি উদ্ধৃতি স্মরণীয়-“সমাগম-এ শওকত ওসমান জাতীয়-আন্তর্জাতিক পটভূমিতে সমকালের জীবন সত্যকে উম্মোচন করেছেন। নাট্যদৃশ্যের আঙ্গিকে ঔপন্যাসিক বর্তমানের বাস্তবতা এবং মৃতলোকের ব্যবধানকে লুপ্ত করে সুখী, সমুন্নতা এক বিশ্বজীবনের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা শহরের একটি গৃহে সমাগত হয়ে হাসি, গান, কৌতুক, বিতর্ক এবং জ্ঞানগর্ভ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে বিশ্বের প্রয়াত মনীষীবৃন্দ সমকালীন বিশ্বসংকটের স্বরূপ নির্দেশ করেছেন এবং সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। উপন্যাসটির আদ্যন্ত অভিব্যক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানবিক ঘৃণা ও ক্ষোভ। উচ্চারিত হয়েছে বিশভ্রাতৃত্ব ও মানবতার জয়গাঁথা।” (উক্টর রফিকউল্লাহ খান, বাংলাদেশের উপন্যাসঃ বিষয় ও শিল্পরূপ, রা/এ, ঢাকা, জুন,১৯৯৭,পৃষ্ঠা-১৩৫)।

‘সমাগম’ উপন্যাসের শওকত ওসমান মৃতলোকের বিখ্যাত মনীষীদের চরিত্রের বিপরীতে জীবিতা লোকের জুহা চরিত্রকে ঘিরে জাইদুন, ফুয়া, সৈয়দ বোকজা, পাষ- তেছোদীন ও মোসাদেদ বখতের চরিত্র অংকন করেছেন। এই দুই শ্রেণির চরিত্রকে গভীরভাবে দেখলে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায়। সেটি হলো- মৃতলোকের বাসিন্দাদের এ উপন্যাসে অবাস্তব মনে হলেও নিজস্ব কালের বিচারে এদের সবার বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। পক্ষান্তরে জীবিত লোকের বাসিন্দাদের বাস্তব লোকের মনে হলেও বস্তব ক’টি  চরিত্রই লেখকের কল্পনার ফসল।

জীবিত লোকের বাসিন্দাদের মধ্যে উপন্যাসের গল্প ঘটনার মূল কেন্দ্রে রয়েছেন সাংবাদিক জুহা। তার বাসগৃহে অতিথি সমাগমের পর প্রতিটি চরিত্রই তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, গান, আনন্দ এবং সমকালীন বিশ্বের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করেন ও সে সব সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজেন। এই আলোচনায় অতীত বর্তমান উভয়ই সমানভাবে প্রাধান্য পায়। আসর শেষে হবার মুহুর্তে শেষ রাতে আকস্মিকভাবে মৃতলোক থেকে রবীন্দ্রনাথ ও তলস্তয় এসে যোগ দেন। অতিথি সমাগম শেষে শ্লোগানের ভাষায় মহৎ মানবিক বক্তব্য উচ্চারিত হয়। জুহার বন্ধু সৈয়দ বোক্জার কন্ঠে ধ্বনিত হয়, ‘মানুষের বিশ্বভ্রাতৃত্ব অক্ষয় হোক। ‘বার্নার্ডশ’ ঘোষণা করেন, ‘ধ্বংস হোক, সাম্রাজাবাদীগণ ও অনুচরেরা ধ্বংস হোক’। টলস্তয় উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন, মানুষের নির্বোধতম সংগঠন হিসেবে ধ্বংস হোক যুদ্ধ’। আর সব শেষে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে সুললিত রাগের মতো শোনায় তাঁর আবেদনমুখর কন্ঠস্বর, ‘সুখীতর, আরো সমৃদ্ধতর হোক আগামী দিনের পৃথিবী’। 

এভাবেই শওকত ওসমান জীবনার্থের মানবমুখিতায় ইতিহাসের ঘটনাক্রম ও চরিত্রপাত্রের মধ্যেও সমকালীন মানুষের আত্ম-সন্ধান, সত্তাসন্ধান ও জাতিসত্তাসন্ধানের নিগূঢ় ভাবনাবীজ আবিষ্কারে সমর্থ হয়েছেন। উপন্যাসের চরিত্রসমূহের নিজ নিজ সময় ও সমাজ লালিত জীবনাদর্শের ও দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য সত্ত্বে¡ও তাদের মুখ থেকে যে বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তাতে ঐক্যসূত্র বিদ্যমান। তাঁরা যে সবাই মানবদরদী, শোষণ অবিচার ও যুদ্ধ বিরোধী মানুষের শান্তি ও কল্যাণের জন্য নিবেদিত প্রাণ- তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘শুধুমাত্র স্বাধীনতা নয়, মানুষের সামগ্রিক মুক্তির জন্যে যে চিন্তা- তারই ফসল এ উপন্যাসটি।’

‘সমাগমে’র এই ফ্যান্টাসীপূর্ণ আলোচনা সভার জীবিত ও মৃতলোকের বাসিন্দারে মধ্যে নানাধিব প্রসঙ্গ আলোচিত হয়। অতীতের অভিজ্ঞতা ও বর্তমানের বাস্তবতার তুলনামূলক বিচারে মনীষীদের জীবনের ভুল-ভ্রান্তি, সমালোচনা ও আত্ম-সমালোচনা স্থান পায়। মহাকবি আলাওল ফরিদপুর থেকে তৎকালীন আরাকান যাত্রার সময় মেঘনায় যে পর্তুগীজ হার্মাদের কবলে পতিত হয়েছিলেন, সেই কাহিনী দিয়ে কথোপকথন শুরু হয় । সে দিনের হার্মাদের সেই বীভৎসতার সাথে আজকের দিনের বীভৎসতার কোন পার্থক্য নেই। আজ সারা পৃথিবী জুড়ে আগ্রাসন মানবতাকে হতচকিত করে। তাদের সেই আড়াইশ’ বছরের শাসন ত্রাসন থেকে রক্ষা পাননি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বা জর্জ বার্নাড শ’। এ কারণে মাইকেলের ক্ষোভও ব্যক্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। মাইকেল সমাগত অতিথিদের বলেছেন “বুকে অনেক জ্বালা ছিল বন্ধু। দেশবাসীদের অজ্ঞতাপ্রসূত জ্বালা, দারিদ্র্যের দাবদাহ- তাই মাইকেল কোনদিন স্থির থাকতে পারে নি। মদ্যপের মতোই ডাইনে-বামে ঝুঁকে ভারসাম্য রাখতে গিয়েছিল।” (সমাগম, শওকত ওসমান, পৃষ্ঠা-৬০)।

সৈয়দ বোক্্জা মাইকেলকে সাম্রাজবাদীদের পাশবিকতা আরও স্পষ্ঠভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন। দস্যুরাও তাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জা অনুশোচনা বোধ করে। কিন্তু এরা দস্যুবৃত্তির জন্য গর্বও অনুভর করেঃ “সভ্যতার ব্যাপক বিস্তার সম্ভব হয়নি। এই সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে । জার্মান, ইংরেজ-ফরাসী এবং ওদের বিশ্বময় যত ভাই-বেরাদার আছে, তারা নিজেরাও পরস্পরের গলা কাটাকাটি করে। আর এদের জন্যই পৃথিবীর মানুষে মানুষে এত বিভেদ । এমনকি এই জন্তুরা শুধু রঙের জন্য মানুষ্যত্বকে আসামীর কাঠগড়ায় তোলে।”(সমাগম, পৃষ্ঠ-৬৬)। আলোচনার এক পর্যায়ে মনীষী বৃন্দ ‘ক্ষণোক্ত’- শীর্ষক নাটকে অভিনয় করেন । এই নাটকের মধ্যেই মানব সমাজের নানা অসঙ্গতি ও তার থেকে মুক্তির পথ নির্দেশ করা হয় । নাটকীয় সংলাপে মাইকেলের জিজ্ঞাসা ছিলো- “আমি বহুবার ভেবেছি এই অমঙ্গল আসে কোত্থকে? কেন মানুষের মধ্যে এক শ্রেণির জানোয়ার জন্মায়, আর তারা হঠাৎ কতো প্রাণ ঘরবাড়ি ধ্বংস করে চলে যায়। উত্তরে বার্নাড শ’ বলেছেন- ‘ব্যাপারটা কোন ব্যক্তি বিশেষের নয় সমাজের কলকব্জা ঠিকমত সমাজও তখন প্রকৃতির মত প্রতিশোধ নেয়। অজ্ঞতা থেকেই অমঙ্গলের উৎপত্তি’।

উপন্যাসের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ ও টলস্টয়ের উপস্থিতি বিশ্বমানবতার মহিমান্বিত বাণীকে আরও বলিষ্ঠভাবে উপস্থাপনার সাহায্য করেছে। আলোচনার উপান্তে সম্মিলিত অতিথিবৃন্দের মুখে বিশ্বভ্রাতৃত্বের উন্মোচন ও দৃঢ় বন্ধনের জন্য সোচ্চার উচ্চারণ ও আর্ন্তজাতিক চেতনার স্ফূরণ ঘটেছে।

‘সমাগমে’ উপস্থিত এক সময়ের প্রথিতযশা এসব মনীষী যারা পৃথিবীতে বাসযোগ্য, মোহনীয় ও সহনীয় করে তুলেছেন, তাঁদের নিজ নিজ যুগ ও জীবন বোধের পার্থক্য সত্ত্বেও সকলেই সমমনোধর্মী। এরা মনে করেন, আধুনিক বিশ্বে ব্যক্তিতান্ত্রিকতা থেকে জাত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কলুষ স্পর্শে এ পৃথিবীর বায়ু দুষিত হয়ে গেছে। তাই সমাগমের উৎসব রাত্রিতে তাঁরা সমস্বরে আগামী দিনের সুন্দর পৃথিবীর কল্যাণ শ্লোগানের ধ্বনিতে মুখর করে তোলেন।’ (শিরীণ আখতার, বাংলাদেশের তিনজন ঔপন্যাসিক, পৃষ্ঠা-৮০)। উপন্যাসে এইসব বিচিত্রধর্মী মনীষীবর্গ একটি জায়গায় এসে প্রত্যয়ী ঘোষণার মধ্য দিয়ে একমত হতে পেরেছেন যে, তারা বন্ধ্যা যুগের অচলায়তন ভাঙবার জন্য, সত্যের অপমৃত্যুকে রোধ করবার জন্য, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কল্যাণসাধনের জন্য বিশ্বভাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা চান – চান চান সাম্রাজ্যবাদীদের ধংস আর যুদ্ধের অবসান’।

শওকত ওসমান ‘সমাগম’ উপন্যাসে ইতিহাসচেতন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সংকীর্ণ শ্রেণি দৃষ্টি ভঙ্গির খাত পরিত্যাগ করে বৃহত্তর ধারা প্রবাহে একাত্ম হতে পেরেছেন। এ উপন্যাস এক মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ লেখকের সামষ্টিক পরিকল্পনার ফসল।

সহায়ক গ্রন্থ:

১। অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়, কালের প্রতীমা, ১৯৭৪।

২। রফিকউল্লাহ খান, বাংলাদেশের উপন্যাস ঃ বিষয় ও শিল্পরূপ।

৩। অনীক মাহমুদ, বাংলা কথা সাহিত্যে শওকত ওসমান, ১৯৭৫।

৪। শিরীণ আখতার, বাংলাদেশের তিনজন ঔপন্যাসিক, বা/এ, ১৯৯৩।

৫। বুলবন ওসমান, কথা সাহিত্যে শওকত ওসমান, ২০০৪।

মন্তব্য: